মাদককে না বলো, মাদকাসক্তি একটি ব্যাধি
প্রথম আলো ট্রাস্ট গত ২৩ মে এক যুগ পূর্তি করেছে। ১২ বছরে প্রথম আলো ট্রাস্ট সামাজিক উন্নয়নমূলক নানাধর্মী কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। সার্বিক কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত বিষয়গুলো নিয়ে সাত দিন থাকছে সাতটি ধারাবাহিক পর্ব। আজ থাকছে প্রথম আলো ট্রাস্ট মাদকবিরোধী আন্দোলন নিয়ে ষষ্ঠ পর্ব।
মাদকবিরোধী আন্দোলন প্রথম আলোর সামাজিক দায়বদ্ধ কাজের মধ্যে অন্যতম। মাদকদ্রব্য সেবনের অভ্যাসটি যখন একজন ব্যক্তির নেশায় পরিণত হয়, তখন তা একসময় তাঁর মানসিক ও শারীরিক নির্ভরতার অবলম্বনে পরিণত হয়। নেশাজাতীয় দ্রব্যের প্রতি ক্রমাগত আকর্ষণ বৃদ্ধি পায়। দৈনন্দিন মাদকের ওপর নির্ভরতা বাড়তে থাকে। ধীরে ধীরে মাদক গ্রহণের মাত্রা বাড়তে থাকে। নেশা তার সব মনোযোগ কেড়ে নেয়। চেনা মানুষটি ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে। দৈনন্দিন জীবনের সব ধরনের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে। নির্ঘুম কাটে রাত কিংবা বিশৃঙ্খল জীবনে দিনরাত একাকার হয়ে যায়।
মাদকাসক্তি সারা বিশ্বে একটি সামাজিক সমস্যা। আমাদের দেশে কিশোর ও তরুণদের মধ্যে মাদকদ্রব্য গ্রহণের প্রবণতা ব্যাপকভাবে বেড়ে চলেছে। সর্বনাশা নেশার চোরাস্রোতে তলিয়ে যেতে বসেছে আমাদের তরুণসমাজ। মাদকাসক্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। চিন্তিত হয়ে পড়েছেন অভিভাবকেরা, কিন্তু সমাধানের রাস্তা খুঁজে পাচ্ছেন না। মাদক পাচার ও মাদকাসক্তির হার কমানোর জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। সরকারকে সম্ভাব্য সব রকমের সহায়তা দিচ্ছে জাতিসংঘ। তবে এ পাপের আগ্রাসন ঠেকানোর জন্য আজ জরুরি হয়ে পড়েছে সবার সম্মিলিত উদ্যোগ।
মাদকাসক্তি একধরনের আত্মঘাতী মানসিক ব্যাধি। আসক্তরা শারীরিক ও মানসিকভাবে অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হচ্ছে। অনেকেই ‘দেখি না কী হয়’, এই আগ্রহ থেকে মাদক গ্রহণ করা শুরু করে। এ এক ভয়ংকর নেশা। একবার–দুবার মাদক গ্রহণ করলে যে কেউই এতে আসক্ত হয়ে পড়তে পারে। একবার মাদকে আসক্ত হয়ে পড়লে সেখান থেকে বের হয়ে আসা খুব মুশকিল। কিশোর–কিশোরীদের মাদক থেকে দূরে রাখা এবং সচেতনতা তৈরির মাধ্যমে তরুণসমাজকে মাদকমুক্ত করার লক্ষ্যে ২০০৩ সালের ১ মে যাত্রা শুরু হয় মাদকবিরোধী আন্দোলনের। ২০০৯ মাসের ২৩ মে প্রথম আলো ট্রাস্টের কার্যক্রম শুরু হলে মাদকবিরোধী আন্দোলনের কার্যক্রম ট্রাস্টের অধীনে চলে আসে। প্রথম আলো ট্রাস্ট মাদকবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে নিয়মিতভাবে মাদকবিরোধী সংগীতানুষ্ঠান, মাদকবিরোধী মানববন্ধন, প্রতি মাসে মাদকবিরোধী পরামর্শ সহায়তা সভা, গোলটেবিল বৈঠক, শোভাযাত্রা, মাদকবিরোধী বন্ধুমেলা, কনসার্টসহ বিভিন্ন কর্মতৎপরতা চালিয়ে থাকে। প্রথম আলো মাদকবিরোধী আন্দোলনের স্লোগান ‘মাদককে না বলো, মাদকাসক্তি একটি ব্যাধি’। অনুষ্ঠানের পাশাপাশি মাদকসংক্রান্ত প্রতিবেদন, ক্রোড়পত্র, বিজ্ঞাপন, সম্পাদকীয় ও চিঠিপত্র প্রকাশ করা হয়ে থাকে। সারা দেশে স্টিকার, পোস্টার, লিফলেট বিলি করা হয়, যা মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করে।
মাদকের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার অংশ হিসেবে ২০০৩ সাল থেকে গত ১৮ বছরে প্রায় প্রতি মাসেই পরামর্শ সহায়তা সভা আয়োজিত হয়েছে, এ ছাড়া মাদকবিরোধী কনসার্ট হয়েছে ১৭টি। একই সঙ্গে সচেতনতা সৃষ্টিতে প্রতিবছর মাদকবিরোধী স্টিকার ডিজাইন প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হয়।
মাদকবিরোধী পরামর্শ সহায়তা সভা
প্রথম আলো ট্রাস্ট মাদকবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নিয়মিত কার্যক্রম পরামর্শ সহায়তা অনুষ্ঠান। করোনা সময়ের আগপর্যন্ত প্রতি মাসে সাধারণত ঢাকার ধানমন্ডি ডব্লিউভিএ মিলনায়তনে এ আসর অনুষ্ঠিত হতো। ঢাকার বাইরেও এই পরামর্শ সহায়তা সভা হতো। এই পরামর্শ সহায়তা সভাগুলোতে মাদকাসক্ত তরুণ-তরুণী, মাদকাসক্তের পরিবার, আত্মীয়স্বজন উপস্থিত থাকতেন। মাদকাসক্ত ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন রকমের সমস্যা তুলে ধরতেন। পরামর্শ সভায় উপস্থিত বিশেষজ্ঞ মনোরোগ চিকিৎসকেরা সবার প্রশ্নের উত্তর দিতেন। সেই পরামর্শ সহায়তা অনুষ্ঠানের বিস্তারিত প্রথম আলোতে প্রকাশিত হতো।
করোনার সময়ে এই পরামর্শ সহায়তা সভাটি অনলাইনে করা হয়। প্রতি মাসে দ্বিতীয় ও চতুর্থ সপ্তাহে বিকেল ৪টায় প্রথম আলো, প্রথম আলো ট্রাস্টের ফেসবুক পেজ এবং প্রথম আলোর ইউটিউব চ্যানেল থেকে আয়োজনটি সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। এই আয়োজনেও দর্শকেরা সরাসরি যুক্ত হয়ে বিশেষজ্ঞ মনোরোগ চিকিৎসকদের প্রশ্ন করে প্রয়োজনীয় উত্তর জেনে নেন। অনলাইন আয়োজনের বিস্তারিতও প্রথম আলো ট্রাস্টের ওয়েবসাইটে বিস্তারিত প্রকাশিত হয়ে থাকে। এ পর্যন্ত ধানমন্ডি ডব্লিউভিএ মিলনায়তনে ১২০টি এবং করোনার সময়ে অনলাইনে ২০টিসহ মোট ১৪০টি পরামর্শ সহায়তা সভা করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস
করোনাকালে এই মহামারির আগপর্যন্ত প্রথম আলো মাদকবিরোধী আন্দোলন ‘আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস’-এ নানা উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে পালন করা হতো। ঢাকা মহানগরসহ সারা দেশে ব্যাপক কর্মসূচি পালন করা হতো। বিশেষ এই দিবস উদ্যাপনের আয়োজনে ছিল মাদকবিরোধী কনসার্ট, মানববন্ধন, শোভাযাত্রা, মাদকবিরোধী শপথ, মাদকবিরোধী আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আয়োজনগুলোতে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, প্রশাসনের বিশিষ্টজন, বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, মনোরোগ চিকিৎসকসহ সর্বস্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করতেন।
মাদকবিরোধী সেরা প্রতিবেদন পুরস্কার
মাদকের ব্যবহার ও মাদক ব্যবসার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য প্রথম আলো ট্রাস্ট টেলিভিশন ও সংবাদপত্র দুটি শাখায় মাদকসংক্রান্ত প্রতিবেদনের জন্য প্রতিবছর সাংবাদিকদের পুরস্কার দেওয়া হয়।
স্কুলভিত্তিক মাদকবিরোধী আয়োজন
করোনা সময়ের আগে স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য নিয়মিত ‘এসো মাদকমুক্ত জীবন গড়ি’ নামে মাদকবিরোধী আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর ও চট্টগ্রামের স্কুলে মাদকবিরোধী সেমিনার আয়োজন করা হয়েছে। এসব আয়োজনে মূলত স্কুলের শিক্ষার্থীদের মাদক থেকে কীভাবে বিরত রাখা যায়, মাদকের ক্ষতিকারক দিক, মাদককে ‘না’ বলার চর্চা ব্যক্তিত্বে আয়ত্ত করা, মাদকাসক্ত হয়ে যাওয়ার লক্ষণগুলো এবং তা থেকে সচেতনভাবে নিজেকে বের করে আনার উপায়গুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আয়োজনে চিকিৎসক ও পরামর্শকেরা থাকতেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদকবিরোধী উদ্যোগ
কোভিডের আগপর্যন্ত প্রথম আলো ট্রাস্ট মাদকবিরোধী আন্দোলন ঢাকা মহানগর ও দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদকবিরোধী আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। মূলত শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরির জন্যই এই আয়োজন করা হতো। এ ছাড়া প্রথম আলোর পাঠক সংগঠন বন্ধুসভার উদ্যোগে মাদকবিরোধী বন্ধু মেলার বন্ধুরা মাদককে ‘না’ বলার শপথ নেন। বাংলাদেশের প্রায় ৩০টি জেলায় বন্ধুসভার বন্ধুদের নিয়ে মাদকবিরোধী কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছে। এতে বন্ধুদের নিজেদের মধ্যেও মাদকের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি হয় এবং একই সঙ্গে বন্ধুরা মাদকবিরোধী আন্দোলনের একজন দক্ষ কর্মী হিসেবে গড়ে উঠতে পারেন। বিভিন্ন সময়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে প্রথম আলো ট্রাস্ট মাদকবিরোধী আন্দোলন মুক্ত সংলাপের আয়োজন করেছে। মন্ত্রী ও প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও সংলাপে অংশ নেন এবং সংলাপ থেকে প্রাপ্ত সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।
প্রচেষ্টা বৃথা যায়নি
প্রথম আলো ট্রাস্ট মাদকবিরোধী আন্দোলন মূলত বাংলাদেশের কিশোর-কিশোরী, তাদের অভিভাবক, শিক্ষক-শিক্ষিকা ও সমাজের সবাইকে মাদকের ভয়াবহতা, ক্ষতিকারক দিক, সন্তান বা প্রিয় মুখ মাদকাসক্ত হওয়ার লক্ষণ, কীভাবে একজনকে মাদকমুক্ত থাকতে হয়, অন্যকে মাদকমুক্ত রাখার জন্য কী কী করতে হবে, বাবা–মায়েদের কীভাবে সচেতন ভূমিকা পালন করতে হবে, মাদকাসক্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কোথায় চিকিৎসাসেবা পাওয়া যাবে, মাদক–সংক্রান্ত এসব বিষয় সম্পর্কে সচেতন করার চেষ্টা করে যাচ্ছে সেই শুরু থেকে।
আমাদের এসব প্রচেষ্টা একদম বৃথা যায়নি। পরামর্শ সহায়তা সভা থেকে পরামর্শ ও সেই মোতাবেক চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ–স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন, এমন বন্ধুর সংখ্যাও আমাদের কম নয়। আমরা চাই, মাদক নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বাড়ুক, কিশোর-কিশোরীরা নিজেরাই যেন বুঝতে পারে, যে মাদক নিতে বলে, সে আসলে প্রকৃত বন্ধু নয়। আমাদের তরুণ প্রজন্ম জানুক এবং বিশ্বাস করতে শিখুক যে মাদককে ‘না’ বলাই স্মার্টনেস। আমরা চাই, অভিভাবকেরা জানুক সন্তানকে মাদকের ভয়াল থাবা থেকে মুক্ত রাখতে হলে শুধু সন্তানের জিপিএ-৫–এর ওপর জোর দিলেই হবে না, বরং অভিভাবক হিসেবে তাঁদেরও জিপিএ-৫ পেতে হবে। সন্তানের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশতে হবে। যাতে সন্তান তাদের সঙ্গে সব উৎসাহ–উৎকণ্ঠা, ভালো-মন্দ বলার জায়গাটা পায়।
মাদকের চিকিৎসা
আমাদের অনেকের মধ্যেই মাদকের চিকিৎসা ও চিকিৎসাপদ্ধতি নিয়ে একটা ভ্রান্ত ধারণা আছে। অনেকেই মনে করেন, মাদকের চিকিৎসা করে কোনো লাভ নেই। জীবনভর এই আসক্তি থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই। কিংবা মাদকাসক্ত ব্যক্তির বিয়ে দিয়ে দিলে সে সংসারের দায়িত্বে সুস্থ জীবনে ফিরে আসবে।
করোনাকালের আগে ও পড়ে অনলাইন পরামর্শ সহায়তা সভাসহ, সব ধরনের সচেতনতামূলক আয়োজনে আমরা বিষয়টি খুব গুরুত্বের সঙ্গে জানানোর চেষ্টা করেছি যে মাদকাসক্তি একটি মানসিক রোগ। যথাযথ বৈজ্ঞানিক চিকিৎসার মাধ্যমে এই আসক্তি থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হওয়া সম্ভব। আবার অনেকেই একবার চিকিৎসা নিয়ে ফিরে আসার পর পুনরায় যখন আসক্ত হয়ে পড়ে, তখন তার পরিবার হতাশ হয়ে যায়। সেই ক্ষেত্রে চিকিৎসা নিয়ে আসা ব্যক্তিটির পরিবার ও পরিবারের সদস্যদের আচরণ কেমন হওয়া উচিত, সেই বিষয়েও সচেতন করা হয়েছে। সর্বোপরি, দুর্ঘটনাবশত যদি পরিচিত কেউ মাদকের কবলে পড়েই যায়, তাহলে কোথায় চিকিৎসা নেওয়া যেতে পারে, সেই ব্যাপারেও আমরা সব সময় সবাইকে অবহিত করার চেষ্টা করে গেছি এবং ভবিষ্যতেও আমাদের এই প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
সচেতনতা প্রতিটি মানুষের নিজস্ব শিক্ষা, চেতনা ও মূল্যবোধের বহিঃপ্রকাশ। যা কিছু ভালো, তার সাথে থাকার প্রত্যয় নিয়ে মাদকের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার, সবাইকে সচেতন করার এই প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছি। ভালোর সাথে আলোর পথে প্রথম আলো ট্রাস্টের এই যাত্রা চিরন্তন। আমরা বিশ্বাস করি, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও সহযোগিতায় একদিন এই সমাজ, এই বাংলাদেশ মাদকমুক্ত হবে। আমাদের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সবাই একসঙ্গে সমস্বরে বলে উঠবে, ‘মাদককে না বলো’।
লেখক: সমন্বয়ক, প্রথম আলো ট্রাস্ট।