অনন্ত সম্ভাবনার অদম্য মেধাবী

প্রথম আলো ট্রাস্ট ২৩ মে, ২০২১ সালে এক যুগ পূর্তি করছে। গত ১২ বছরে প্রথম আলো ট্রাস্ট সামাজিক উন্নয়নমূলক নানাধর্মী কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। সার্বিক কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত বিষয়গুলো নিয়ে সাত দিন থাকছে সাতটি ধারাবাহিক পর্ব। আজ থাকছে অদম্য মেধাবী তহবিল নিয়ে তৃতীয় পর্ব।

এইচএসসি পর্যায়ে বৃত্তি পেয়ে সংবর্ধনা পাওয়া অদম্য শিক্ষার্থীরা। ৩ অক্টোবর, ২০১৯ রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে
ছবি: প্রথম আলো

পাঁচ সন্তান নিয়ে টানাটানির সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম শহীদুল্লাহর বাবা ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময় শহীদুল্লাহকে বাদাম কিনে দিয়েছিলেন বিক্রি করার জন্য। এক দিন আগেও স্কুলের ছাত্র থাকা শহীদুল্লাহ আজ বাদাম বিক্রি করছে। মেনে নিতে পারছিল না ছোট শহীদুল্লাহ। স্কুলের এক শিক্ষকের সহায়তায় আবার ক্লাস থ্রিতে ভর্তি হলেন।

বাদাম বিক্রি আর পড়াশোনা পাশাপাশি চলতে থাকল। ২০০৮ সালে পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পেয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা চলল। তত দিনে শহীদুল্লাহ আর বাদাম বিক্রি করে না। বাবার সঙ্গে সারা রাত চাতালে (ধান ভাঙানো, চাল তৈরির) কাজ করে। আর দিনের বেলা স্কুলে যায়। দিনের কোনো এক ফাঁকে ঘুমিয়ে নিত।

রাস্তার লাইটে পড়াশোনা করেছে। বস্তা সেলাইয়ের কাজ করেছে। এতটুকু বয়সে জীবনের সব কঠিন চেহারা দেখেছে কিন্তু পড়াশোনা ছাড়েনি। ২০১৪ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে স্বপ্ন দেখে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার। পলিটেকনিকে ভর্তি হয়।

প্রথম আলো ট্রাস্টের শিক্ষাবৃত্তির টাকায় পড়াশোনা করতেন আর টিউশনির টাকা বাড়িতে পাঠাতেন। সেই শহীদুল্লাহ এখন ওয়ালটন হাই টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডে সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট ইনভেনটরি অফিসার-১ হিসেবে কর্মরত আছেন।
বর্ষা রানী বীণার গল্পটাও এমন। তাঁর উপজেলার প্রথম নারী তিনি, যিনি কিনা সরকারি চাকরি করার সুযোগ পেয়েছেন। কিংবা এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের সিনথিয়া খন্দকার ঊর্মির কথাই ভাবি। যিনি কিনা তাঁর পরিবারের প্রথম কন্যাসন্তান, যে উচ্চশিক্ষা পেয়েছেন। এখন ফ্রান্সের প্যারিসে বিজনেস ডেভেলপমেন্ট অফিসার হিসেবে কাজ করছেন। উসাইম্যা মারমা, ই-জেন কনসালট্যান্টের প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট অফিসার কিংবা সাদিয়া ইসলাম; যাঁরা পরিবারের প্রথম নারী সদস্য হিসেবে আজ জীবনে সফল হয়েছেন। অনন্ত সম্ভাবনা নিয়ে অদম্য মেধাবীর এমন হাজার হাজার গল্প আছে প্রথম আলো ট্রাস্টের।

ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে দেশের কল্যাণে অতিথিদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের শপথ। ৩ অক্টোবর, ২০১৯ রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে
ছবি: প্রথম আলো

প্রথম আলো ট্রাস্টের যে কটি প্রধান কর্মসূচি রয়েছে, তার মধ্যে অদম্য মেধাবী তহবিল একটি। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে সুবিধাবঞ্চিত যে শিক্ষার্থীরা জীবনসংগ্রামের পাশাপাশি লেখাপড়া চালিয়ে কৃতিত্ব অর্জন করেন, তাঁদের সাফল্যের কাহিনি নিয়ে পত্রিকা প্রকাশের পর থেকে সাংবাদিকেরা নিয়মিত সংবাদ পাঠাতে থাকেন। প্রথম আলো তাঁদের বলেছে ‘অদম্য মেধাবী’। পরে প্রথম আলো অদম্যদের নিয়ে শুধু সংবাদ প্রকাশেই সীমাবদ্ধ না থেকে তাঁদের নিয়ে কিছু করার কথা ভাবে। সেই ভাবনা থেকেই নেওয়া হয় অদম্য মেধাবীদের জন্য শিক্ষাবৃত্তির উদ্যোগ।

শুরুর দিকে প্রথম আলোর নিজস্ব তহবিল, ট্রান্সকম গ্রুপ, সামিট গ্রুপ, আমেরিকা অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সহায়তা দেয়। পরে প্রথম আলো ২০০৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে অদম্যদের শিক্ষাবৃত্তি চালু করে। ওই বছর ২১ জন অদম্য মেধাবীকে শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হয়। ২০১০ সাল থেকে ব্র্যাক ব্যাংক এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়। অদম্য মেধাবী তহবিলের আওতায় ২০২০ সাল পর্যন্ত ১ হাজার ৩৫ জন শিক্ষার্থী বৃত্তি পেয়েছেন। এর মধ্যে ব্র্যাক ব্যাংকের সহায়তায় ৮১১ জন, অন্যান্য ব্যক্তি ও দাতা সংস্থার সহায়তায় ২২৪ জনকে বৃত্তি দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে বৃত্তি পাচ্ছেন ২৪০ শিক্ষার্থী। স্নাতক পর্যায়ে বৃত্তিপ্রাপ্ত ২৬৪ জনের মধ্যে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০৭, মেডিকেল কলেজে ১৯, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩২, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫৫ ও দরিদ্র কোটায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন। করোনার কারণে স্নাতক (সম্মান) পর্যায়ের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত না হওয়ায় ২০২০ সালের ৪৩ জন এখনো ভর্তি হতে পারেননি।

অদম্য মেধাবী সংবর্ধনা-২০১৮ অনুষ্ঠানে অতিথিদের সঙ্গে অদম্য মেধাবী ও তাদের অভিভাবকেরা। কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তন, ফার্মগেট। ২৩ অক্টোবর
ছবি: সাইফুল ইসলাম

প্রথম দিকে শুধু এইচএসসি পর্যায়ের অদম্য মেধাবীদের দুই বছরের জন্য শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হতো। পরে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়া অদম্য মেধাবীদের মধ্যে যাঁরা এইচএসসিতেও জিপিএ-৫ পেয়েছেন, তাঁদের উচ্চশিক্ষার জন্য শিক্ষাবৃত্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ব্র্যাক ব্যাংক। উচ্চশিক্ষার জন্য বৃত্তি দেওয়া শুরু হয় ২০১০ সাল থেকে।

অদম্য মেধাবী সংবর্ধনা-২০১৭ তে কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত এই মেধাবীরা। ১৪ অক্টোবর, সিএ ভবন, কারওয়ান বাজার, ঢাকা
ছবি: প্রথম আলো

প্রতিবছর নতুন করে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়া ৫০ জন দরিদ্র শিক্ষার্থীকে এই ব্যাংকের সহায়তায় শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হয়। ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগিতায় প্রথম আলো ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনায় কার্যক্রমটি পরিচালিত হয়। প্রথম আলোর সাংবাদিকেরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে অদম্য মেধাবীদের নির্বাচন করেন। প্রতিবছর উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক পর্যায়ে শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হয়। বৃত্তির জন্য নির্বাচিত শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন মেয়াদে বৃত্তি সহায়তা পেয়ে থাকেন। উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে দুই বছর, স্নাতক পর্যায়ে চার বছর (মেডিকেল শিক্ষার্থীদের পাঁচ বছর) এবং ডিপ্লোমা পর্যায়ে চার বছর বৃত্তি পান শিক্ষার্থীরা।

অদম্য এই পথযাত্রায় আমরা শামিল করেছি পরিবারের প্রথম কন্যাসন্তানকে, যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাবেন। পরিবারের প্রথম নারী, অদম্য প্রাণশক্তি নিয়ে যিনি প্রতিকূলতা জয় করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রেখেছেন, তিনিই আমাদের অদ্বিতীয়া। ২০১২ সাল থেকে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন এবং প্রথম আলো ফার্স্ট ফিমেল ইন দ্য ফ্যামিলি স্কলারশিপ অ্যাওয়ার্ড নামে শিক্ষাবৃত্তি প্রদান শুরু করে।

অদম্য মেধাবী সংবর্ধনা-২০১৭ অনুষ্ঠানে অতিথিদের সঙ্গে এসএসসি পরীক্ষায় অসামান্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখা শিক্ষার্থীরা। ১৪ অক্টোবর, সিএ ভবন, কারওয়ান বাজার, ঢাকা
ছবি: প্রথম আলো

প্রতিবছর পরিবারের প্রথম নারী অথচ দরিদ্র, যিনি উচ্চতর শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সমাজ গঠনে আগ্রহী, এ রকম ১০ জনকে ট্রান্সকম গ্রুপের সহায়তায় এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন এ শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া শুরু করে। ট্রান্সকমের সহায়তায় ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৪২ জন শিক্ষার্থী এই বৃত্তি পেয়েছেন। ২০১৭ সাল থেকে আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেড এই শিক্ষাবৃত্তির দায়িত্ব নেয়। নামকরণ করা হয়েছে অদ্বিতীয়া। আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের সহায়তায় ৩৬ জনসহ এ পর্যন্ত মোট ৭৮ জন শিক্ষার্থী এই বৃত্তি পেয়েছেন। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনও তাঁদের আবাসন, টিউশন ফি সুবিধাসহ নানা সুযোগ দেয়।

এভাবেই সারা দেশ থেকে বাছাই করে অদম্যদের পথচলার সঙ্গী হয় প্রথম আলো ট্রাস্ট। হার না মানা অদ্বিতীয়ারা, অপ্রতিরোধ্য অদম্যরা যখন তাঁদের জীবনে চলার পথে আলো ছড়াতে থাকেন, তখন তাঁদের সঙ্গে সঙ্গে প্রথম আলো ট্রাস্টও গর্ববোধ করে। তবে মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা আর ভালোর সাথে আলোর পথে এই যাত্রা শেষ হয় না।

অতিথিদের কাছ থেকে মেডেল গ্রহণ করার পর স্নাতক পর্যায়ে বৃত্তি পাওয়া ২৭ জন অদম্য শিক্ষার্থী। ৩ অক্টোবর, ২০১৯ রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে
ছবি: প্রথম আলো

একেকজন অদম্য শহীদুল্লাহ, বর্ষা, রাকিব, মুক্তা, সুজন কিংবা অদ্বিতীয়া সাদিয়া, উসাইম্যা, তামান্নার জীবনপথ তৈরির পর প্রথম আলো ট্রাস্ট খুঁজতে থাকে আগামীর অদম্যদের, ভবিষ্যতের অদ্বিতীয়াদের।
লেখক: সমন্বয়ক, প্রথম আলো ট্রাস্ট।