রানা প্লাজায় ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে প্রথম আলো ট্রাস্ট
প্রথম আলো ট্রাস্ট ২৩ মে, ২০২১ সালে এক যুগ পূর্তি করছে। গত ১২ বছরে প্রথম আলো ট্রাস্ট সামাজিক উন্নয়নমূলক নানাধর্মী কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। সার্বিক কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত বিষয়গুলো নিয়ে সাত দিন থাকছে সাতটি ধারাবাহিক পর্ব। আজ থাকছে মেরিল-প্রথম আলো সাভার সহায়তা তহবিল নিয়ে পঞ্চম পর্ব।
রানা প্লাজার পঞ্চম তলায় নিউ ওয়েভ স্টাইল লিমিটেডে অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন নিলুফা বেগম। বেলা ১১টার দিকে হঠাৎ করেই যেন তাঁর পায়ের নিচের ফ্লোর কেঁপে ওঠে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই চারপাশ অন্ধকার হয়ে ভবনটি ধসে পড়ে।
নিলুফার পায়ের ওপর ভবনের একটি বিম পড়ে। প্রাণে বেঁচে গেলেও বিমের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় তাঁর ডান পা। দুর্ঘটনার প্রায় সাড়ে ৯ ঘণ্টা পর উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হয় তাঁকে। চিকিৎসার জন্য সরকারি–বেসরকারি সহায়তা পেলেও পঙ্গুত্বের হাত থেকে মুক্তি পাননি। চলাচলের জন্য তাঁর ভরসা হয় স্ট্রেচার কিংবা হুইলচেয়ার। মেরিল-প্রথম আলো সাভার সহায়তা তহবিল থেকে এক লাখ টাকা সহায়তা দেওয়া হয় নিলুফা বেগমকে। সহায়তার অর্থে একটা চায়ের দোকান দেন তিনি। চা বিক্রি করে অর্জিত আয়ে কোনোমতে চলত তাঁর সংসার। কিন্তু পায়ের সমস্যার কারণে দোকান একসময় বন্ধ করতে হয়। আবার ভর্তি হতে হয় চিকিৎসার জন্য। সবকিছুর পরও তাঁর চোখে একটাই স্বপ্ন, একমাত্র সন্তান রিফাত পাটোয়ারীকে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিতে মারা যান ময়না বেগম। তাঁর চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া একমাত্র মেয়ের পড়ার খরচ চলত ময়না বেগমের টাকায়। দুর্ঘটনার ১৫ দিন পর ময়না বেগমের লাশ উদ্ধার হয়। দিনমজুর বাবার পক্ষে মা–হারা মেয়ে মাহিয়ার পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়া অসম্ভব ছিল। পাশে দাঁড়ায় প্রথম আলো ট্রাস্ট। মেরিল-প্রথম আলো সাভার সহায়তা তহবিলের শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হয় মাহিয়াকে। মাহিয়া এখন বরিশালের উজিরপুর উপজেলার সরকারি শেরেবাংলা ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। দুর্ঘটনার শিকার পরিবারের সদস্যরা কেবল স্বজনই হারাননি, বহু পরিবার বহুমাত্রিক সংকটে পড়েছিল। তবে একটু সহায়তা যে অনেকের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে, মেরিল-প্রথম আলো সাভার সহায়তা তহবিল তার প্রমাণ রেখেছে।
সাভারের রানা প্লাজা ভবনে ফাটল দেখা দেয় ২০১৩ সালের ২৩ এপ্রিল। ফাটল দেখা দেওয়ায় ওই ভবনের পাঁচটি পোশাক তৈরি কারখানার কর্মীদের ছুটি দিয়ে দেওয়া হয় সেদিন। পরের দিন ফাটল ধরা ভবনে কয়েক হাজার কর্মীকে ডেকে আনা হলো কাজে যোগ দিতে। সেদিনই ঘটল বাংলাদেশ পোশাকশিল্পের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। ৯ তলা রানা প্লাজা ভবন ধসে পাঁচটি পোশাক কারখানার অন্তত ১ হাজার ১৩৬ জন শ্রমিক প্রাণ হারান। আহত হন দুই হাজারের বেশি শ্রমিক।
রানা প্লাজা ধসের দুই দিন পর ২৬ এপ্রিল ‘মেরিল-প্রথম আলো সাভার সহায়তা তহবিল’ গঠিত হয়। পূর্বনির্ধারিত মেরিল–প্রথম আলো অনুষ্ঠানে ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ছিল শোকের পরিবেশ। পূর্বনির্ধারিত মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার-২০১৩-এর অনুষ্ঠানটি উৎসর্গ করা হয়েছিল রানা প্লাজা ধসে দুর্গত ব্যক্তিদের।
অনুষ্ঠানে প্রথম আলোর সাংবাদিক ও কর্মীদের এক দিনের বেতন থেকে দুই লাখ টাকা দিয়ে একটি তহবিল ঘোষণা করেন সম্পাদক মতিউর রহমান। এরপর স্কয়ার টয়লেট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী ঘোষণা করেন ১০ লাখ টাকা অনুদানের। অনুষ্ঠানে শিল্পী ও কলাকুশলীরা একে একে ঘোষণা করতে থাকেন তাঁদের অনুদানের কথা। অনুষ্ঠানস্থলেই রানা প্লাজা দুর্ঘটনার ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার জন্য তহবিল সংগ্রহ করা শুরু হয়। বিভিন্ন অঙ্গনের শিল্পী ও কলাকুশলী অনুদান দেন। মোট ৫৪ লাখ টাকা নিয়ে এ তহবিল যাত্রা শুরু করে। সাভারের রানা প্লাজা ধসের ঘটনার প্রথম দিন থেকেই প্রথম আলো ট্রাস্টের পক্ষ থেকে বন্ধুসভা ওষুধ ও সরঞ্জাম নিয়ে ঘটনাস্থল ও হাসপাতালগুলোতে কাজ শুরু করে। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ তহবিলে সহায়তা প্রদান করেন। পরে সহায়তা করেন সমাজের সর্বস্তরের মানুষ।
সব মিলিয়ে সাভার সহায়তা তহবিলে বিভিন্ন সময়ে জমা হয় প্রায় ২ কোটি ২৪ লাখ টাকা। এর থেকে প্রায় ৭১ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয় হয় উদ্ধারকাজ ও চিকিৎসা কার্যক্রমে। ১ কোটি ৫০ হাজার টাকা খরচ হয় ক্ষতিগ্রস্ত ১০১ জন মানুষের পুনর্বাসন সহায়তায়। তহবিলের বাকি টাকা থেকে ৫০ লাখ টাকার স্থায়ী আমানতপত্র করা হয়।
এই আমানতপত্র থেকে রানা প্লাজায় ক্ষতিগ্রস্ত ও নিহত ব্যক্তিদের ২০ জনের সন্তানদের শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। এই তহবিলের বৃত্তি নিয়ে যশোরের মিসকাতুল মারিয়া চতুর্থ শ্রেণি, সাভারের তানজির আহমেদ ষষ্ঠ, মানিকগঞ্জের মৃদুল হোসেন অষ্টম, রংপুরের মেহেদী হাসান নবম, যশোরের জান্নাতুল ফেরদৌস, মানিকগঞ্জের মাহবুবা রহমান, ময়মনসিংহের কামরুজ্জামান ও গোপালগঞ্জের খাদিজা আক্তার দশম এবং বরিশালের তানজিলা আক্তার, দিনাজপুরের মনিকা আক্তার ও পাবনার শারমিন আক্তার দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ছে। আর ফিন্যান্সে স্নাতক করছেন খুলনার রেদোয়ান হোসেন। এর বাইরে সুমনা হক এসএসসির পর আর পড়ালেখা করেননি।
রাঈমা জাহান স্নাতক করেছেন, হাসান ইমাম ডিপ্লোমা করেছেন শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে। এ শিক্ষাবৃত্তির উদ্দেশ্যই হলো রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় নিহত ও আহত শ্রমিকদের সন্তানদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করা। শিক্ষার্থীদের স্নাতকোত্তর পর্যন্ত এ সহায়তা দেওয়া হয়।
দুর্ঘটনার ৮ বছর কেটে গেছে। যাঁরা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ হারিয়েছেন, তাঁরা প্রতিনিয়ত বয়ে বেড়াচ্ছেন সেই দিনের দুঃস্মৃতি। আর যাঁরা স্বজন হারিয়েছেন, তাঁরা শুধু স্বজন নয়, হারিয়েছেন বেঁচে থাকার সাহসটুকুও। থমকে গিয়েছিল ছোট ছোট চোখগুলো জুড়ে থাকা বড় বড় স্বপ্ন। মেরিল-প্রথম আলো ট্রাস্ট সাভার সহায়তা তহবিল সেই স্বপ্নগুলোকে ঝরে যেতে দেয়নি। থামতে যেতে দেয়নি তাদের পথচলা। সাহস জুগিয়েছে সামনে এগিয়ে যাওয়ার। সেই সাহস আর অনুপ্রেরণা থেকেই আর্কিটেক্টে ডিপ্লোমা শেষ করেছেন হাসান ইমাম। তাঁর বাবা ইসরাঈল বিশ্বাস দুর্ঘটনায় নিহত হন সেদিন। হাসান ইমামের বোন রাঈমা জাহান কম্পিউটার সায়েন্সে স্নাতক শেষ করে বর্তমানে অনলাইনে কাজ করছেন কনটেন্ট রাইটার হিসেবে।
দুই ভাইবোনই এখন স্থায়ী চাকরি খুঁজছেন। আমরা চাই, মেরিল-প্রথম আলো সাভার সহায়তা তহবিল থেকে শিক্ষাবৃত্তিপ্রাপ্ত যশোরের মারিয়া, সাভারের তানজির, মানিকগঞ্জের মৃদুল, মাহবুবা, বরিশালের তানজিলাসহ সবাই যেন স্বাবলম্বী হয়ে ওঠেন। স্বজন হারানোর এই শোক যেন তাঁদের শক্তি হয়ে ওঠে। সব বাধাবিপত্তি পেরিয়ে তাঁদের মুখের হাসি যেন আজীবন অমলিন থাকে। এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক: সমন্বয়ক, প্রথম আলো ট্রাস্ট।