দুর্গত মানুষের পাশে প্রথম আলো ট্রাস্ট
প্রথম আলো ট্রাস্ট গত ২৩ মে ২০২১ সালে এক যুগ পূর্তি করল। গত ১২ বছরে প্রথম আলো ট্রাস্ট সামাজিক উন্নয়নমূলক নানাধর্মী কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। সার্বিক কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত বিষয়গুলো নিয়ে ৭ দিন থাকছে ৭টি ধারাবাহিক পর্ব। আজ থাকছে ত্রাণ তহবিল নিয়ে দ্বিতীয় পর্ব।
পাকা বসতঘর, গোলাভরা ধান, গোয়ালভরা গরু—এমনটা নিয়েই সুখী বেওয়ার সুখের সংসার শুরু হয়েছিল। ৭১ বছরের সুখী বেওয়ার সেই সুখ আর নেই। ৫০ বছরে ১৫ বার নদীভাঙনে ঘর গেছে নদীর পেটে। স্বামী মারা গেছেন, সন্তানেরা খোঁজখবর নেয় না। দফায় দফায় যমুনার ভাঙনে সুখী বেওয়া আজ একেবারে নিঃস্ব। নামে সুখী হলেও জীবনযুদ্ধে বারবার হোঁচট খেয়েই চলেছেন। ২০২০-এর বন্যায় বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার চালুয়াবাড়ী ইউনিয়নের আউচারপাড়া চরে প্রথম আলো ট্রাস্টের ত্রাণসহায়তা পৌঁছে দিতে গিয়ে বন্ধুসভার বন্ধুরা খোঁজ পান এই সুখী বেওয়ার। ত্রাণসামগ্রী হাতে পেয়ে সুখী বেওয়া বলেন, ‘কোনোরকমে গুচ্ছগাঁওত আসি আচি। মানুষের বাড়িত চায়্যাচিন্ত্যা খাই। ৩ মাসে ১৬ সের চাউল ইলিপ পাচনো। চাউল সিদ্ধ কর্যা পান্তাভাত খাচি।’
সুখী বেওয়ার পর ফিরে আসি সৈয়দপুরের বানিয়াপাড়া গ্রামের প্রতিবন্ধী ৫৭ বছরের বৃদ্ধ আব্দুল আজিজের কাছে। এ বছরের জানুয়ারিতে তীব্র শীতে তাঁর হাতে কম্বল তুলে দেওয়ার পর তিনি বলেন, ‘মুই হাটির পাওনা। জারের দিনে খুব কষ্ট করির নাগে। জারের কষ্ট বড় কষ্ট বাহে। আল্লাহ তোমাক বাঁচে থুউক।’ কম্বল নিতে এসেছিলেন উপজেলার কামারপুকুর ইউনিয়নের কিসামত ধলাগাছ গ্রামের বৃদ্ধা জাহানারা বেগম। তিনি বলেন, ‘ছেঁড়া খ্যাতাত শুতি থাকি। একখান কম্বল কাহও দেয় না বাহে। প্রথম আলো পেরথম এখান কম্বল দিলে, আইজ নিন্দ পাড়ি শান্তি পাইম এনা।’
এভাবেই মানুষের প্রয়োজনে মানুষের কাছে, মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ায় প্রথম আলো ট্রাস্ট। ২০০৭ সালে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূলে যখন সিডর আঘাত হেনেছিল, ত্রাণকাজের জন্য প্রথম আলোর ত্রাণ তহবিলে ৩ কোটি ৮ লাখ ৪২ হাজার ৫১২ টাকা জমা পড়েছিল। সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন ও সহায়তায় এই টাকা খরচ হয়। আবার ২০০৯ সালে যখন আইলা আঘাত করল, তখনো তহবিলে জমা পড়ে ৪৬ লাখ ৩৭ হাজার ২৯৪ টাকা। এই টাকার সবটাই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সহায়তায় ব্যয় করা হয়। ২০০৯ সালে প্রথম আলো ট্রাস্ট গঠনের পর দেশব্যাপী অসহায় মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার কাজ করে যাচ্ছে প্রথম আলো ট্রাস্ট। দেশের যেকোনো দুর্যোগ মোকাবিলা করার জন্য গঠিত হয়েছে প্রথম আলো ট্রাস্ট ত্রাণ তহবিল। সিডর, আইলা, বন্যা কিংবা যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের আঘাত অথবা তীব্র শীতে নাকাল অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে প্রথম আলো ট্রাস্ট। দেশের কোনো এলাকা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, পাহাড়ধসে রাঙামাটির আকাশ ভারী হয়ে উঠেছে, তাৎক্ষণিকভাবে ছুটে গেছে প্রথম আলো ট্রাস্ট।
২০১২ সালে ঘূর্ণিঝড় মহাসেনের আঘাতে বিপর্যস্ত ১০০০ পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছিল প্রথম আলো ট্রাস্ট। ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত দেশের ১৪৬টি জায়গায় ২৭ হাজার ১৮৬ জন শীতার্ত মানুষকে শীতবস্ত্র দিয়ে পাশে থেকেছে ট্রাস্ট। ২০১৭ সালে রাঙামাটির ভয়াবহ পাহাড়ধসে যখন পাহাড়ে কান্নার রোল উঠল, সেই সময় ১৩ লাখ টাকার সহায়তা নিয়ে ট্রাস্ট পৌঁছেছে পাহাড়ে। একই বছর যখন বন্যায় দেশের দক্ষিণাঞ্চল নিমজ্জিত হলো, তখন দেশের ২৯টি জায়গায় প্রায় ১৯ হাজার মানুষের কাছে সহায়তা পৌঁছে দিয়েছে ট্রাস্ট। পরবর্তী বছরগুলোতে বন্যার প্রকোপ একটু কম হলেও শীতের তীব্রতা কাঁপিয়ে দিয়ে গেছে সারা দেশ। সেই সময় ২০১৮-২০১৯ সালেও শীতবস্ত্র বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত ছিল। সেই দুই বছরে দেশের ৬৬টি জায়গায় ৯ হাজার ৪০০ জনের হাতে কম্বল তুলে দিয়েছে প্রথম আলো ট্রাস্ট। ২০২০ সালের বন্যা সারা দেশে এক ভয়াবহ অবস্থা তৈরি করে। একদিকে আম্পানের আঘাত, অন্যদিকে বন্যা ‘সঙ্গী’ ছিল করোনা। আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত ১০টি জেলায় ৪ হাজার ১১৫টি পরিবারকে ২৮ লাখ টাকার ত্রাণ বিতরণ করা হয়। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ২৬টি জেলায় প্রায় ৪৪টি জায়গায় ৮ হাজার ৮০০টি পরিবারকে ৩৯ লাখ ২০ হাজার টাকার ত্রাণসহায়তা দেওয়া হয়।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত নওগাঁর মান্দা উপজেলার বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের কর্ণভাগ গ্রামের অজিত কুমারের (৪৮) ত্রাণ নিতে এসে বলেন, ‘হামাগের কপালটাই খারাপ। মছিবত হামাগের পেছন ছাড়িচ্ছে না। একটার পর একটা বিপদে বেঁচে থাকাই কষ্ট হয়ে গ্যাছে।’ বন্যার সময় ত্রাণসামগ্রী হাতে পেয়ে মানিকগঞ্জের ছুটি ভাটাবাউর গ্রামের রুবিয়া বেগম (৪০) বলছিলেন, ‘যত সমস্যা আমাগো মতো গরিব মাইনষের।’ প্রথম আলো ট্রাস্ট চেষ্টা করেছে এসব মানুষের পাশে দাঁড়াতে।
আম্পান ও বন্যার আঘাত সামলে ২০২০ সাল পার করতে না করতেই আবার শীতের মৌসুম চলে আসে। শুরু হয় শীতবস্ত্র বিতরণের কাজ। ২০২১ সালের ২ জানুয়ারি থেকেই প্রথম আলো ট্রাস্ট শীতবস্ত্র নিয়ে ছুটে গেছে শীতার্ত মানুষের কাছে। ৩০টি জেলায় প্রায় ৫ হাজার ৪০০ মানুষের হাতে প্রায় ১২ লাখ ২৫ হাজার টাকার বেশি শীতবস্ত্র পৌঁছে দেওয়া হয়।
সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় ইয়াস পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আঘাত হানলেও বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি জায়গা প্লাবিত হয়েছে। জোয়ারের পানি বেড়ে, বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে ঘরহারা হয়েছে দেশের শত শত মানুষ। প্রথম আলো ট্রাস্ট তাদের পাশেও দাঁড়াবে। তবে দুর্যোগে, দুর্ভোগে মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারায় আমাদের যে ভালো লাগা কাজ করে, মানুষের মুখে হাসি দেখে আমাদের চোখ যে স্বস্তি-তৃপ্তি পায়, তার কৃতিত্ব কেবল আমাদের একার নয়। প্রথম আলোর শুভানুধ্যায়ীদের ভালোবাসা ও সহায়তায় পরিচালিত হয় ত্রাণ তহবিলের কাজ। প্রথম আলোর কর্মীরাও তাঁদের এক দিনের বেতন দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন বিভিন্ন সময়। ট্রাস্টের সব সহায়তা নিয়ে বন্ধুসভার বন্ধুরা পাশে দাঁড়িয়েছেন বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে। প্রথম আলো ট্রাস্টের অকৃত্রিম বন্ধু প্রথম আলো বন্ধুসভার বন্ধুরা। যেকোনো দুর্যোগের সময়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসেন তাঁরা।
ট্রাস্টের সহায়তাগুলো যেন অসহায় মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছায়, সেই পর্যন্ত তাঁরা নিশ্চিত করেন। প্রথম আলো ট্রাস্টের ১২ বছরের এই পথচলায় আমরা অকৃত্রিমভাবে ধন্যবাদ জানাতে চাই আমাদের শুভানুধ্যায়ী, দাতা ও বন্ধুসভার বন্ধুদের। যাঁরা অর্থ দিয়ে আমাদের সহায়তা করেছেন, অসহায়দের হাতে ত্রাণ তুলে দিয়ে আমাদের কৃতজ্ঞ করেছেন। প্রথম আলো ট্রাস্ট সব সময় মানুষের জন্য, মানুষের পাশে ছিল, আছে এবং থাকবে। প্রথম আলো ট্রাস্ট চায় দেশের মানুষের মুখের অমলিন হাসিটা ধরে রাখতে।
প্রথম আলো ট্রাস্টের ত্রাণ কার্যক্রমে আপনিও অংশগ্রহণ করতে পারেন। সহযোগিতা করতে চাইলে নিম্নোক্ত ব্যাংক হিসাবে আপনার অনুদান পাঠাতে পারেন।
ব্যাংক হিসাবের নাম: প্রথম আলো ট্রাস্ট/ত্রাণ তহবিল
হিসাব নম্বর : ২০৭ ২০০ ১১১৯৪
ঢাকা ব্যাংক লিমিটেড, কারওয়ান বাজার শাখা, ঢাকা।