আর একটি মুখও যেন অ্যাসিডে ঝলসে না যায়

গত ২৩ মে এক যুগ পূর্তি করল প্রথম আলো ট্রাস্ট। গত ১২ বছরে প্রথম আলো ট্রাস্ট সামাজিক উন্নয়নমূলক নানাধর্মী কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। সার্বিক কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত বিষয়গুলো নিয়ে সাত দিন থাকছে সাতটি ধারাবাহিক পর্ব। আজ থাকছে অ্যাসিডদগ্ধ নারীদের জন্য সহায়ক তহবিল নিয়ে চতুর্থ পর্ব।

অ্যাসিড নিক্ষেপকারীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে ভোলা সদর উপজেলার উত্তর দিঘলদী এলাকায় অ্যাসিডদগ্ধ নারীদের জন্য প্রথম আলো সহায়ক তহবিলের উদ্যোগে ভোলা বন্ধুসভা মানববন্ধনের আয়োজন করে। ১৪ মে ২০১৮, ভোলা
ছবি: প্রথম আলো

প্রতিদিনের মতো রাতে ঘুমানোর আগে বিনুনি করে ঘুমাতে গিয়েছিলেন অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী শামীমা। কিন্তু সেই ঘুমের রাত গভীর হওয়ার আগেই মাঝরাতে তাঁর আর্তচিৎকারে ঘুম ভেঙে যায় সবার। ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়ার পর জানা গেল, অ্যাসিড–সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন শামীমা। ১৯৯৬ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর এই সহিংসতার শিকার হয়েছিলেন শামীমা।

ঘটনার এত বছর পরও শামীমা জানেন না কে সেই দুর্বৃত্ত। সেই রাতের ক্ষত শুধু শরীরে না, মনেও বয়ে বেড়াচ্ছেন। দুর্ঘটনার পরের দুই বছর প্রায় ১৪টি অপারেশন তাঁর জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল। লোকজন কানাঘুষা করত তাঁর বদলে যাওয়া মুখের আদল নিয়ে। ১০ বছর নিজেকে এক রকম লুকিয়ে রেখেছিলেন শামীমা। কিন্তু ভালোর সাথে আলোর পথের যাত্রীরা থেমে থাকবেন কেন? থেমে থাকেননি শামীমাও। অ্যাসিডদগ্ধ নারীদের জন্য সহায়ক তহবিলের সহযোগিতায় ২০০৫ সালে আবার পড়াশোনা শুরু করেন শামীমা। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে ভর্তি হন কলেজে। সেলাই করতে ভালোবাসতেন তিনি। কলেজে পড়ার সময়েই নির্যাতিত ও গরিব নারীদের নিয়ে গড়ে তুললেন একটি প্রতিষ্ঠান।

শামীমা বলেন, ‘এইচএসসি পাসের পর প্রথম আলোকে জানাই আমার স্বপ্নের কথা। তারা আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে পড়ার ব্যবস্থা করে দেয়। সহযোগিতা করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও। আমার স্বপ্ন আবার গতি পায়।’

গ্রামের মানুষের কথায় কুঁকড়ে যাওয়া শামীমার মনোজগৎ পাল্টে গেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীদের সহযোগিতা ও ভালোবাসায়। তাঁর বন্ধুরাই তাঁকে বোঝান যে এই দুর্ঘটনায় তাঁর কোনো দোষ নেই, দায় নেই। মনোবল নিয়ে ঘুরে দাঁড়ান শামীমা। পরবর্তী সময়ে ঢাকার শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজিতে ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে স্নাতকোত্তর পাস করে এখন একটি নামকরা প্রতিষ্ঠানে ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে কর্মরত শামীমা আকতার।

থেমে থাকেননি মাসুদা আক্তার, মনিকা হালদার, মারজিয়া আক্তার, আসমা আক্তার, রিপা খানমেরাও। প্রথম আলোর সাংবাদিকদের এক দিনের বেতন দিয়ে ২০০০ সালের ১৯ এপ্রিল অ্যাসিডদগ্ধ নারীদের জন্য প্রথম আলো সহায়ক তহবিলের যাত্রা শুরু। মূলত তহবিলটি চলছে প্রথম আলোর পাঠক ও শুভানুধ্যায়ীদের আর্থিক সহায়তা দিয়ে।

বগুড়ায় অ্যাসিড–সন্ত্রাস বেড়ে যাওয়ায় বগুড়া শহরে অ্যাসিডদগ্ধ নারীদের জন্য প্রথম আলো সহায়ক তহবিলের উদ্যোগে মুক্ত আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। এতে অংশ নেন অ্যাসিডদগ্ধ নারীসহ প্রশাসন, সুধীসমাজ
ছবি: প্রথম আলো

করপোরেট প্রতিষ্ঠানের কর্মী, স্কুলপড়ুয়া ছোট ছেলেমেয়েরা, পোশাককর্মী, নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক অনেকেই আছেন এই সহায়তা প্রদানের তালিকায়। সহায়ক তহবিলের পক্ষ থেকে ৫ জন অ্যাসিডদগ্ধ নারীকে শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হয়। তাঁরা যত দিন লেখাপড়া চালিয়ে যেতে চান, তত দিন এই বৃত্তি অব্যাহত ছিল। তাঁদের মধ্যে পড়াশোনা শেষ করে একজন ফ্যাশন ডিজাইনার হয়েছেন। দুজন ব্র্যাক ব্যাংকে কর্মরত এবং একজন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। একজন পরিবার পরিকল্পনা দপ্তরে পরিবার কল্যাণ সহকারী পদে চাকরি করছেন।

‘আর একটি মুখও যেন অ্যাসিডে ঝলসে না যায়’ অঙ্গীকার নিয়ে প্রথম আলো অ্যাসিড-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন, ফিচার, সম্পাদকীয় বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছে। ‘যেখানে অ্যাসিড–সন্ত্রাস, সেখানেই প্রতিরোধ’ প্রতিপাদ্যে অ্যাসিড-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি করা, জনমত গড়ে তোলার পাশাপাশি অ্যাসিড–সহিংসতার শিকার নারীদের নানা রকম সহায়তা দিয়েছে ‘অ্যাসিডদগ্ধ নারীদের জন্য প্রথম আলো সহায়ক তহবিল’।

২০০৯ সাল থেকে প্রথম আলো ট্রাস্ট এই তহবিলের দায়িত্বভার গ্রহণ করে। এ পর্যন্ত ৪৫৬ জন অ্যাসিডদগ্ধ নারীকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩০২ জনকে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। তাঁদের জমি, ঘর, দোকান, গবাদিপশু, ট্রলার দেওয়ার মাধ্যমে অ্যাসিড-সন্ত্রাসের শিকার নারীদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করার প্রয়াস চালানো হয়েছে। পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে এখন পর্যন্ত ৪২ জন নারীকে দোকান তৈরি করে দেওয়া হয়। ক্ষুদ্র ব্যবসা ও পুঁজি দিয়ে সহায়তা করা হয় ১৩ জনকে, ১০৫ জনকে গাভি, ১২ জনকে রিকশা/ ভ্যান এবং ১০ জন অ্যাসিডদগ্ধ ভূমিহীন নারীকে জমি কিনে বাড়ি করে দেওয়া হয়েছে।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে ২০১২ সালে জাতীয় শহীদ মিনারের সামনে র‌্যালির আয়োজন করা হয়। অ্যাসিডদগ্ধ নারীদের জন্য প্রথম আলো সহায়ক তহবিল ও অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশন এই র‌্যালির আয়োজন করেছিল
ছবি: প্রথম আলো

অ্যাসিডদগ্ধ নারীদের জন্য সহায়ক তহবিলের আর্থিক সহায়তায় ১০০ জন অ্যাসিডদগ্ধ নারীকে চিকিৎসাসেবা দিয়ে সুস্থ করে তোলা হয়েছে। একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, খুলনা যশোর, সাতক্ষীরা এলাকায় বেশি অ্যাসিড-সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটে।

ঢাকায় এনে তাঁদের চিকিৎসা করানো বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। সেই ক্ষেত্রে ঢাকা থেকে বিশেষজ্ঞ সার্জনেরা খুলনার সিএসএস আবদুল ওয়াদুদ মেমোরিয়াল হাসপাতালে গিয়ে অ্যাসিডদগ্ধ রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন। এ ছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের রোগীদের জন্য বিশেষ ট্রলি, পানি গরম করার গিজার, স্পটলাইট কেনাসহ আরও নানা উন্নয়নকাজে এ তহবিল থেকে টাকা দেওয়া হয়েছে।

অ্যাসিড-সন্ত্রাসের শিকার নারীরা যেন আইনি সহায়তা পান, সেই জন্য অ্যাসিডদগ্ধ নারীদের জন্য সহায়ক তহবিলের পক্ষ থেকে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। পাবনা, পটুয়াখালী ও কুমিল্লায় তিনটি, গাইবান্ধায় দুটি মামলায় আইনি সহায়তা দেওয়া হয়েছে। গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার বড় গোবিন্দপুর গ্রামের গৃহবধূ মঞ্জুয়ারাকে (২২) অ্যাসিড ছোড়ার দায়ে অ্যাসিড নিক্ষেপকারী তিনজনকে ১৪ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানার আদেশ দিয়েছেন আদালত।

অ্যাসিডদগ্ধ নারীদের স্বাবলম্বী করে তুলতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল তাঁদের কারিগরি ক্ষেত্রে দক্ষ করে গড়ে তোলা। এ লক্ষ্যে পারসোনা বিউটি কেয়ার লিমিটেডের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে আটজন অ্যাসিডদগ্ধ নারীকে রূপসজ্জার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণ শেষে তাঁরা পারসোনায় কর্মরত।

প্রথম আলো ট্রাস্ট বিশ্বাস করে, মাসোহারা দেওয়ার চেয়ে টেকসই আয়ের উৎস তৈরি করে দেওয়া বেশি জরুরি। তবু শারীরিকভাবে একেবারে অক্ষম, এমন অ্যাসিডদগ্ধ দুজনকে প্রতি মাসে মাসোহারা দেওয়া হচ্ছে। যেকোনো সহিংসতা, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দূর করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা।

অ্যাসিডদগ্ধ নারীদের জন্য প্রথম আলো সহায়ক তহবিল ২০০২ সালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অ্যাসিড–সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে র‌্যালির আয়োজন করে। এএসএফ ও ব্র্যাক ওই র‌্যালিতে সহযোগিতা করেছিল
ছবি: প্রথম আলো

ভবিষ্যতে অ্যাসিড-সন্ত্রাস যাতে বন্ধ হয়, সে লক্ষ্যে প্রথম আলো সহায়ক তহবিল সচেতনতা সৃষ্টির প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছে সবচেয়ে বেশি। সভা–সমাবেশ, মতবিনিময়, বিশেষ করে ঢাকার বাইরে যেসব এলাকায় অ্যাসিড-সন্ত্রাসের আধিক্য রয়েছে, সেখানে জনমত সৃষ্টিতে কাজ চলে জোরেশোরে। খুলনা, ভোলা, সিরাজগঞ্জ, নরসিংদী, দিনাজপুরে এ ধরনের বড় মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। অ্যাসিড-সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য হংকংয়ের ফরেন করেসপনডেন্ট ক্লাব প্রথম আলোকে দ্য গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড অ্যাওয়ার্ড-২০১০ প্রদান করে।

কঠোর আইনি ব্যবস্থা, গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার ও বহুমুখী কার্যক্রমের ফলে অ্যাসিড-সন্ত্রাসের ঘটনা কমে এসেছে। অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনের (এএসএফ) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯ বছরের মধ্যে ২০০২ সালে অ্যাসিড-সন্ত্রাসের ঘটনা ছিল সবচেয়ে বেশি—৪৯৪টি। ২০০৩ সালে ৪১৭টি। ২০০৪ সালে ৩২৬টি। ২০০৫ সালে ২২২টি। ২০০৬ সালে ১৮৩টি। ২০০৭ সালে ১৬২টি। ২০০৮ সালে ১৪২টি। ২০০৯ সালে ১২৯টি। ২০১০ সালে ১২২টি। ২০১১ সালে ৯১টি। ২০১২ সালে ৭১টি। ২০১৩ সালে ৭০টি। ২০১৪ সালে ৫৯টি। ২০১৫ সালে ৫৯টি। ২০১৬ সালে ৪৪টি। ২০১৭ সালে ৩৯টি।

২০১৮ সালে ১৮টি। ২০১৯ সালে ১৯টি। ২০২০ সালে এমন ঘটনা ঘটেছে ২০টি।
এ বছরের শুরু দিকেও বিচ্ছিন্নভাবে দু–একটি অ্যাসিড-সন্ত্রাসের ঘটনার কথা শোনা গেলেও আমরা চাই, এর সংখ্যা শূন্যে নেমে আসুক। প্রথম আলো ট্রাস্ট অত্যন্ত ভালো লাগার সঙ্গে বলতে চায় যে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সারা দেশে অ্যাসিড-সন্ত্রাসের ভয়ংকর মাত্রা কমেছে। ‘আর একটি মুখও যেন অ্যাসিডে ঝলসে না যায়’, সত্যি সত্যি সেই দিন আসুক।

লেখক: সমন্বয়ক, প্রথম আলো ট্রাস্ট।