আমি মোহাম্মদ নেজামউদ্দীন, ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে এইচএসসি ও স্নাতক পর্যায়ে পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছি। সম্পতি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পটিয়া সরকারি কলেজ থেকে সিজিপিএ-৩.৩০ অর্জন করে বিবিএ (হিসাববিজ্ঞান) পাস করেছি। আমি যে শেষ পর্যন্ত অনার্স সম্পন্ন করতে পারব সেটা আমার কাছে দুঃস্বপ্ন ছিল। কারণ আমি এমন একটা পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি যেখানে অন্ন-বস্ত্র জোগাড় করতে আমার বাবার কষ্টের সীমা ছিল না, সেখানে আমার জন্য লেখাপড়া ছিল কেবল বিলাসিতা। অভাব আমাদের ওপর ঘাপটি মেরে বসেছিল। হতাশা আমার স্বপ্নগুলোকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিয়েছিল। তারপরেও আমি স্বপ্ন বুনতাম। স্বপ্ন দেখতাম নতুন জীবনের। আমার সমগ্র শিক্ষা জীবনে আমাকে ৪ বছর বছর পড়াশোনা থেকে বিরত থাকতে হয়েছে। তারপরেও আমি হাল ছাড়িনি। এ পর্যন্ত আসতে আমাকে অনেক লম্বা পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। আমি প্রতিকূল এক পরিবেশের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে চরম সংগ্রাম করেছি শুধু পড়াশোনা করব বলে।
এতো প্রতিকূলতার পরও হার মানিনি আমি। হার মানিনি দারিদ্র্যের কাছে। হার মানিনি প্রতিকূল পরিবেশের কাছে— অদম্য মেধাবী নেজামউদ্দীন।
আমার বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার অন্তর্গত দক্ষিণ ছনহরা গ্রামে। আমি তখন স্থানীয় এক মাদ্রাসায় পঞ্চম শ্রেণিতে পড়তাম। অভাবের কারণে আমার মা, বাবাকে না বলে আমার দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় বাসায় কাজ করার জন্য দেয়। এ দিকে আমার বার্ষিক পরীক্ষা খুব আসন্ন ছিল। বাবা আমাকে ফিরিয়ে আনার জন্য চেষ্টা করলেন। কিন্তু যারা আমাকে নিয়ে গিয়েছিল তারা কিছুতেই আমাকে আসতে দিচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত আমার বাবা তাঁদের বাসায় গিয়ে আমাকে নিয়ে এলেন। আমি বার্ষিক পরীক্ষা দিলাম কিন্তু ফেল করে বসলাম। কারণ আমি কিছুই পড়তে পারিনি। আমাকে আবার পঞ্চম শ্রেণিতে রেখে দিল। সে বছরই আমার বাবা মারা যান। আমার ভাগ্য ভালো, যে বছর আমার বাবা মারা যান সে বছর আমাদের মাদ্রাসায় এতিমখানা চালু হয়। আমার নতুন ঠিকানা হয় এতিমখানায়।
এতিমখানায় থেকে ষষ্ঠ, সপ্তম আর অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। অষ্টম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে আমি বাড়ি চলে আসি। বাড়ি এসে আমার হতাশা আরও বেড়ে গেল। আমার বড় দুই ভাই আমার বাবা মারা যাওয়ার পর পরই বিয়ে করে ফেলেন। আমার চারজন বোন। তার মধ্যে আবার সবার বড়টা ছিল বাক্প্রতিবন্ধী। চার বোন আর মাকে নিয়ে আমার দুই ভাই তাদের বউ-বাচ্চাসহ চলতে খুব কষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। এই অবস্থায় আমি বাড়ি চলে আসাতে তাদের বোঝা আরও বেড়ে গেল। পরিবারের দুঃখ, দারিদ্র্য— এসব দেখে আমি সিদ্ধান্ত নিই কাজে চলে যাব। নবম শ্রেণিতে উঠের পর এক মাস ক্লাস করেছি। তারপর মাসিক ৯০০ টাকার বেতনে শুঁটকির দোকানে কাজ শুরু করি।
এদিকে কাজ থেকে ফিরে রাতে বসে বসে বিভিন্ন ধরনের বই পড়তাম। আমার পড়তে খুব ইচ্ছে করত। প্রায় এক বছর কাজটি করি। তারপর আবার সিদ্ধান্ত নিই, যে করেই হোক আমি পড়াশোনা করব। পড়াশোনার জন্য আমি গ্রামে চলে যাই। আমার সহপাঠী সবাই দশম শ্রেণিতে উঠে গেছে। জেএসসি-জেডিসির কারণে আমি নবম শ্রেণি থেকে ছিটকে পড়ি। মাদ্রাসার হুজুররা আমাকে আবার অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হতে বলে। তারপর আমি সিদ্ধান্ত নিই, অষ্টম শ্রেণিতে পড়তে হলে মাদ্রাসায় আর পড়ব না। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হব। এক বন্ধুর সাহায্যে নলিনীকান্ত মেমোরিয়াল ইনস্টিটিউটে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হই। তারপর পড়াশোনার খরচ চালাতে তিনটা টিউশন জোগাড় করি। কঠোর পরিশ্রম আর অধ্যবসায় করে ২০১৪ সালের এসএসসি পরীক্ষায় বাণিজ্য বিভাগ থেকে জিপিএ ৫.০০ অর্জন করি।
তারপর পটিয়া সরকারি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হই। আমার পাশে এসে দাঁড়ায় প্রথম আলো। প্রথম আলোর পটিয়ার প্রতিনিধি আব্দুর রাজ্জাক স্যার আমাকে নিয়ে একটা প্রতিবেদন করেন। ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অসচ্ছল, দরিদ্র অথচ মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান করে, সেই তালিকায় আমাকেও রাখা হলো। রাজ্জাক স্যার যেদিন বৃত্তি পাওয়ার খবরটা আমাকে জানালেন, সেদিন আমি খুশিতে খুবই আবেগ আপ্লুত হয়ে গিয়েছিলাম। ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো পাশে দাঁড়ানোর কারণে আমি নিরবচ্ছিন্নভাবে পড়াশোনা করতে লাগলাম। ২০১৬ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় বাণিজ্য বিভাগ থেকে জিপিএ-৪.৯২ পাই। এরপর কোনো কোচিং ছাড়াই নিজে নিজে পড়াশোনা করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ডি’ ইউনিটে ৯৬ তম স্থান অর্জন করি। ভর্তি হই সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। আমি আবারও ৪ বছরের জন্য ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তির জন্য নির্বাচিত হই। আবার শুরু হয় পথচলা।
পারিবারিক টানাপোড়েনের কারণে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বছর পড়ে আমি আবার গ্রামে চলে আসি। এরপর পটিয়া সরকারি কলেজে হিসাববিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হই। আমি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চলে আসার পরেও ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট আমার বৃত্তি বাতিল করেনি। সব সময় আমার পাশে থেকেছে। এ জন্য প্রথম আলোর কাছে আমি খুব কৃতজ্ঞ।
অবশেষে আমি স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। এতোকিছুর পরও হার মানিনি আমি। হার মানিনি দারিদ্র্যের কাছে। হার মানিনি প্রতিকূল পরিবেশের কাছে। এখন আমার লক্ষ্য একটাই, ভালো একটা চাকরি জোগাড় করে পরিবারের পাশে দাঁড়ানো এবং দেশের সেবা করা। তা ছাড়া স্নাতকোত্তর পড়াশোনাটাও চালিয়ে যেতে চাই। আর এ জন্যই যেকোনো একটা চাকরি আমার পরিবার ও আমার জন্য খুবই জরুরি।