‘মানুষের ইচ্ছাশক্তির চেয়ে বড় কিছু নাই’

অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তি প্রাপ্ত ফারুক হোসেন।

ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্টের অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তি প্রাপ্ত ফারুক হোসেনের বাড়ি রংপুর জেলায়। দিনমজুর বাবার অভাবের সংসার, তার ওপর পাঁচ ভাইবোন। ফারুক জানত যে, তাঁকে লড়াই করেই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। স্কুলে ভর্তি হলেন কিন্তু পরিবারে এমন কেউ নাই যে তাঁকে পড়াশোনায় সাহায্য করবে। এলাকায় গণশিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় সবাই যখন পড়াশোনা করত, তাদের পড়া শুনে শুনে ফারুক পড়তেন। এর মধ্যেই ২০০৩ সালে চতুর্থ শ্রেণি শেষে পঞ্চম শ্রেণিতে উঠবেন। সেই সময়ে ফারুক তাঁর মাকে হারিয়ে যেন অসহায় হয়ে পড়েন। পড়াশোনার খরচ, জীবনের বাস্তবতা সব মিলিয়ে যখন পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাবে, ঠিক তখনই দেবদূতের মতো এগিয়ে এলেন ফারুকের স্কুলের সহকারী শিক্ষক মনিরুজ্জামান। সেই ষষ্ঠ শ্রেণি থেকেই ফারুক তাঁর শিক্ষকের কাছে থেকেই পড়াশোনা করেছেন। এমনকি আজ যখন ফারুক রংপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ক্র্যাফট ইনস্ট্রাক্টর হিসেবে কাজ করেছেন, তখনো তিনি তাঁর সেই শিক্ষকের বাড়িতেই আছেন। দশম শ্রেণিতে ওঠার সময় নিজের বাবাকে হারানো ফারুক তাঁর শিক্ষককেই বাবা হিসেবে ডাকেন।

আরও পড়ুন

পালিত বাবার কথা বলতে গিয়ে ফারুক বলেন, 'আমার শিক্ষককেই আমি বাবা বলে ডাকি। উনি আমাকে নিজের সন্তানের মতোই স্নেহ করেন। আমার একটাই স্বপ্ন ছিল, যেভাবেই হোক ভালো ফলাফল আমাকে করতেই হবে। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতেই হবে।' সকলের আশীর্বাদ আর নিজের অক্লান্ত পরিশ্রমে ফারুক জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। নিজের পরিশ্রমের ফলাফল পেয়ে শুধু যে ফারুক তা নয়, পুরো এলাকাবাসী যেন আনন্দে মেতে উঠেছিল সেদিন। কারণ ফারুক তো অনন্য, অদম্য। যেই বাবা ফারুকের জন্য এত কিছু করলেন, তিনি তো ছেলের ভালো ফলাফলের পর তাঁর হাত ছেড়ে দিতে পারেন না। বড় দুই ভাই আর পালক বাবার আর্থিক সহযোগিতায় ফারুক ঢাকার নটরডেম কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু ঢাকায় তো হোস্টেলে থাকতে হবে। হোস্টেলে থাকার পর মাস চলার জন্য কিছু টাকা প্রয়োজন। সেই খরচ দেওয়ার আর্থিক অবস্থা ফারুকের পালিত বাবার ছিল না। এক আত্মীয়ের মাধ্যমে প্রথম আলো ট্রাস্টের কথা জানতে পারেন তাঁরা। এরপর ফারুক ট্রাস্টের কাছে শিক্ষাবৃত্তির জন্য আবেদন করলে ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্টের অদম্য মেধাবী তহবিলের সহায়তায় ফারুক প্রতি মাসে শিক্ষাবৃত্তি পাওয়া শুরু করেন। শুরু হয় ফারুকের নতুন পথচলা।

অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তি প্রাপ্ত ফারুক হোসেন।

ফারুক বলেন, 'প্রথম আলো ট্রাস্টের শিক্ষাবৃত্তি পাওয়ার পর আমার পড়াশোনার পথটা সুগম হয়। অনেক স্বপ্ন নিয়ে ঢাকার একটা ভালো কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। কিন্তু এই শিক্ষাবৃত্তি যদি না পেতাম তাহলে আমাকে বাড়ি ফিরে যেতে হতো। এমনও হতে পারত যে আমার পড়াশোনাই বন্ধ হয়ে যেতো। আমি সারা জীবন ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্টের কাছে কৃতজ্ঞ থাকব।'

২০১১ সালে এইচএসসি পরীক্ষাতেও জিপিএ-৫ পেলেন ফারুক। ফারুক রংপুর বেগম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান এবং সেখান থেকে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) থেকে স্নাতক শেষ করে রংপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ক্র্যাফট ইনস্ট্রাক্টর হিসেবে কর্মরত আছেন। বর্তমান অদম্য মেধাবীদের জন্য ফারুক বলেন, 'পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পরীক্ষা দেওয়ার সময় আমার বাবার কেরোসিন কেনার আর্থিক ক্ষমতা ছিল না। সেই সময়ে আমি মসজিদের গিয়ে মসজিদের লাইটের আলোয় পড়াশোনা করি। আমাকে কেউ বলেনি এমন করতে। আমি নিজের ইচ্ছায় এই কাজটা করেছিলাম ভালো ফলাফলের জন্য। সামনের দিনে ভালো থাকার পথ তৈরি করার জন্য। মানুষের ইচ্ছাশক্তির চেয়ে বড় শক্তি কিছু নাই। চেষ্টা করলে কঠিন পথ পার করা যায়। নিজের ইচ্ছা থাকলে অনেক বাঁধা অতিক্রম করা যায়। সৎ থেকে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সাহস নিয়ে পথ চললে সব বাঁধা অতিক্রম করে সফল হওয়া সম্ভব।'

সামনের দিনে বিসিএস পরীক্ষা দিতে চান ফারুক। তিনি বিশ্বাস করেন প্রশাসনের অংশ হয়ে তিনি বৃহৎ পরিসরে সমাজ ও দেশের মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারবেন। জীবনে সেই জায়গায় যেতে চান যেখান থেকে তিনি তাঁর মতো যারা আছেন, যারা মেধাবী কিন্তু অর্থাভাবে পড়তে পারছেন না, তাদের সহায়তা করবেন। ফারুক বলেন, 'আমার ওপর সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ আছে, যে আমার বাবা-মা আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পরও আমাকে বাবা-মায়ের স্নেহ থেকে বঞ্চিত করেননি। আমার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমি আমার বাবার কাছে, বাবার সঙ্গে থাকতে চাই।'