'ইচ্ছা থাকলে অজয়কে জয় করা সম্ভব’

প্রথম আলো ট্রাস্টের নিয়মিত আয়োজন ‘অদম্য মেধাবীর সঙ্গে’ অনলাইন অনুষ্ঠান।

রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া থানার বড়বিল গ্রামে বাড়ি মো. ফারুক হোসেনের। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়াকালীন সময়ে তাঁর মা মারা যান। বাবা ছিলে দিনমজুর, নবম শ্রেণিতে পড়াকালীন সময়ে বাবাও মারা যান। বাবা-মা দুজনই মারা যাওয়ার পরে ওই এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মুন্নার কাছে আশ্রয় পান। ফারুককে তিনি পালক হিসেবে গ্রহণ করেন এবং নিজের ছেলে হিসেবে তাঁকে পরিচয় দেন। ফারুক নিজেকে মানিয়ে নেয়। প্রতিদিন বাসার কাজ শেষ করে সকাল ১০টা থেকে ৪টা পর্যন্ত স্কুল করতেন। এভাবে ২০০৯ সালে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন তিনি। পরে তাঁর পারিবারিক অবস্থা ও অদম্য মেধাকে বিবেচনায় নিয়ে ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তি প্রদান করা হয়। এই বৃত্তির সহযোগিতায় উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে স্নাতক (সম্মান) শেষ করেছেন। সম্প্রতি রংপুর পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে ক্রাফট ইন্সট্রাক্টর (সপ) পদে সরকারি চাকরি পান। বাধা অতিক্রম করে তাঁর সফল হওয়ার নানা গল্প উঠে আসে ৭ জুলাই ২০২১ প্রথম আলো ট্রাস্টের নিয়মিত আয়োজন ‘অদম্য মেধাবীর সঙ্গে’ অনলাইন অনুষ্ঠানে।

ফারুকের পুরো পথ চলাটা কেমন ছিল জানতে চাইলে বলেন,‘নিম্নবিত্ত পরিবারের সবার একটা গল্প থাকে, আমারও আছে। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে আমি ছিলাম তৃতীয়। বাবা ছিলেন দিনমজুর, অন্যের জমিতে কাজ করে সংসার চলাতেন। সংসারে অভাব-অনটন লেগেই থাকত। তবে আমার মনের ভেতর চেষ্টা ছিল, যেকরেই হোক আমাকে বড় কিছু হতে হবে, ভালো মানুষ হতে হবে। ২০০৩ সালে আমি যখন চতুর্থ শ্রেণিতে তখন মা মারা যাযন। খুব অসহায় হয়ে যাই। পরে আমার শিক্ষক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মুন্না, ওনার আশ্রয় পাই। আমি ওনাকে বাবা বলে ডাকি, ওনিও আমাকে সন্তানের মত দেখেন। সব সময় পড়াশোনার জন্য চাপ দিতেন, ভালো কিছু করার কথা বলতেন। আমিও ভাবতাম যে, আমি ভালো কিছু না করলে হয়তো আমার জীবনটা এখানেই শেষ হয়ে যাবে। তাই কঠিন পরিশ্রম করে ২০০৯ সালে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাই। ইচ্ছা শক্তি মানুষকে কাঙ্খিত লক্ষে নিয়ে যায়। এটা ছিল আমার সফলতার প্রথম ধাপ।’

পরে পালক বাবার পরিচিত এক ব্যক্তির সহযোগিতায় ঢাকার নটরডেম কলেজে ভর্তি হন ফারুক। তিনি জানানেল, ‘ভর্তি হওয়ার পর পড়ালেখার খরচ ও চলার মত অবস্থা ছিল না। পরে প্রথম আলো ট্রাস্টে শিক্ষাবৃত্তির জন্য আবেদন করি। আমার সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে বৃত্তির ব্যবস্থা হয়। এই সহায়তা না পেলে আমার পড়াশোনা হতো না। এটা কখনো ভুলতে পারব না। এ সহায়তা পেয়ে পরে এইচএসসিতেও জিপিএ-৫ পেলাম। আনন্দ অশ্রুতে চোখ আমার ভিজে যায়। আমার এই ধারাবাহিক সফলতায় স্নাতক (সম্মান) পর্যায়েও বৃত্তি অব্যাহত রাখে প্রথম আলো ট্রাস্ট ‘

নতুন অদম্য দের জন্য কি উপদেশ দেবেন জানতে চাইলে জানান, ‘ পরিবারের অবস্থা তো বললাম। এমনও হয়েছে, আমি ১৫ দিন মসজিদে থেকে পড়াশোনা করেছি। সুতরাং ইচ্ছা থাকলে অজয়কে জয় করা সম্ভব। অনেক বাধাকে অতিক্রম করা সম্ভব। ছোটদের বলব, সততা থাকতে হবে ও সৎ হতে হবে এবং কোনো কিছুতেই ভেঙ্গে পড়া যাবে না। বাধাকে শক্তিতে রূপান্তর করতে হবে।’

এখন কি স্বপ্ন দেখেন জানতে চাইলে ফারুক জানান, এখন আমি যেটা স্বপ্নে দেখি তাহলো ভবিষ্যতে বিসিএস দিয়ে প্রশাসন ক্যাডারভুক্ত হওয়া। সততার সহিত কাজ করে নিজ পরিবার, সমাজ এবং দেশের সেবা করব। প্রথম আলো আমাকে যেটা শিখিয়েছে - আমার আশেপাশে যারা আমার মত থাকবে তাদের সহায়তা করব। দরিদ্র মেধাবীদের মেধাকে লালন করার জন্য প্রথম আলো ট্রাস্ট ও ব্র্যাক ব্যাংকের কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।’ পরিশেষ সবাইকে ধন্যবাদ ও দোয়া চেয়ে বিদায় নেন ফারুক।

অনুষ্ঠানটি একযোগে প্রচার করা হয় প্রথম আলোর ইউটিউব চ্যানেল, প্রথম আলোর ফেসবুক, প্রথম আলো এবং প্রথম আলো ট্রাস্টের ফেসবুক থেকে। সঞ্চালনায় ছিলেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা।