শূন্য থেকে আত্মবিশ্বাসী হওয়া তমার গল্প
তমা বর্মার বাবা জয়ন্ত বর্মা চা শ্রমিক। দিনভর খেটে তিনি পেতেন একশত টাকা (এখন ১৭০ টাকা হয়েছে)। এত অল্প টাকায় পরিবারের পাঁচজনের খাবার জোগাড় করা যেখানে অসম্ভব, সেখানে আবার পড়াশোনা? তবু মেয়ে তমা বর্মার অদম্য ইচ্ছে দেখে বাধা হয়ে দাঁড়াননি মা-বাবা। তমা নিজেও চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। পড়াশোনার খরচ চালাতে অষ্টম শ্রেণি থেকে টিউশনি শুরু করেন। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের আলীনগর চা-বাগানে বেড়ে ওঠা তমা এসএসসি ও এইচএসসি পাস করে চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের (এইউডব্লিউ) জনস্বাস্থ্য বিভাগে ভর্তি হলেন। ২০১৯ সালে পেলেন আইডিএলসি-প্রথম আলো ট্রাস্টের ‘অদ্বিতীয়া’ শিক্ষাবৃত্তি। এখন শেষ বর্ষে অধ্যয়নরত আছেন। চা-বাগান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসাটা তমার জন্য সহজ ছিল না। কীভাবে এই অসাধ্যসাধন হলো, সেই গল্প ওঠে এল ০২ মার্চ ২০২৪, শনিবার, বিকেল ৫টায় 'অদ্বিতীয়ার গল্প' অনুষ্ঠানে।
চা-বাগান থেকে এইউডব্লিউতে যাওয়ার গল্প নিয়ে তমা জানালেন, ‘স্বপ্ন পূরণের ধাপ শুরু হবে আমার। প্রথম ধাপ শেষ করে নতুন ধাপে যাব। ৪ বছর হলো এখানে এসেছি। এখন থেকে পরিবারের হাল ধরতে হবে। এটাই আমার শুরু।’
মৌলভীবাজার থেকে চট্টগ্রামে আসার গল্পটাও বললেন তমা। তিনি জানালেন, ‘আমি ছোট থেকেই বাবা-মায়ের সাপোর্ট পেয়েছি। আমাদের বাসায় একটা প্রোগ্রাম ছিল। ওখানে এক আত্মীয়ের মাধ্যমে এইউডব্লিউ সম্পর্কে জানতে পারি। তারপর সময় ক্ষেপণ না শ্রীমঙ্গলে গিয়ে ফরম পূরণ করি। পরে শ্রীমঙ্গলেই লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভাইভায় ডাক পাই। সেখানেও উত্তীর্ণ হয়ে চূড়ান্তভাবে বৃত্তি পেয়ে ভর্তি সুযোগ পাই। আমার পথ চলা শুরু হয়।’
এইউডব্লিউতে একটা কালচারাল ডাইভার্সিটির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে কি? এর উত্তরে তমা বলেন, প্রথমেই যেটা হয়েছিল, পরিবারের সাপোর্ট পেলেও আশপাশের মানুষের সাপোর্ট পাইনি। তারা বলেছে, মেয়ে বড় হয়েছে বিয়ে দিয়ে দাও। যেহেতু প্রত্যন্ত এলাকায় আমাদের বাড়ি, সে জন্য সেখানে সচেতনতার অভাব আছে। তারপরও আমি সব বাধা অতিক্রম করে আসতে পেরেছি। আমার চা-বাগান থেকে আমিই প্রথম কোনো মেয়ে, যে উচ্চশিক্ষার দিকে যেতে পেরেছে। আমি একদম গ্রামের স্কুল ও কলেজে পড়েছি। তাই ইংরেজি ভাষায় তেমন ভালো ছিলাম না। এইউডব্লিউতে যেদিন আসি সেদিন সবার ইংরেজি বলার ধরন ও ফ্লুয়েন্সি দেখছিলাম। প্রথম কয়েক দিন সমস্যা হয়েছে। সিনিয়র আপুরা অনেক সহযোগিতা করেছে। আমি এক মাস রুমে বসে চর্চা করেছি। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে গেছে। সব ভালো লাগা শুরু হলো। সব কনডাক্ট করতে শুরু করি।’
পরক্ষণেই তমা বললেন, ‘এইউডব্লিউতে আসার আগে আমার কনফিডেন্ট লেভেল ছিল শূন্য। এখন আমি অনেক আত্মবিশ্বাসী। আমি অনেক কিছুর সঙ্গে যুক্ত আছি। এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটি করছি। সেই তমা আর এখনকার তমার মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য।’
নিজের কমিউনিটির জন্য কাজ করার তাগিদ কই থেকে পেলেন? এর উত্তরে তমা জানালেন, আমার বাবা চা-শ্রমিক। ১৭০ টাকা মজুরি পান। এটা দিয়ে সব চালানো কঠিন। এখানে শিক্ষার অভাব আছে। এখানে কুসংস্কারে ভরপুর। তাই তাদের সচেতন করা সহ জীবনযাত্রার মান বাড়াতে কাজ করতে চাই। যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পরিশ্রম করছে। তাদের স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করতে চাই। এটা নিয়ে গবেষণা করে কাজ শুরু করব। আমার ইচ্ছা আছে, আরও উচ্চতর পড়াশোনা করার। বাইরে গিয়ে পিএইচডি করতে চাই।’
অনুষ্ঠানটি একযোগে সম্প্রচারিত হয় প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেল থেকে। সঞ্চালনা করেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা।