উড়ে যাওয়া পাখিদের শোক: মানসিকভাবে আমরা কিভাবে পাশে থাকব

অন্যান্য দিনের মতো সোমবার সকালে স্কুলে পাঠিয়েছিলেন প্রিয় সন্তানকে। স্কুলে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে সেই সন্তানের করুণ পরিণতি মেনে নিতে পারছেন না স্বজনেরা। তাঁদের কান্নায় ভারী হয়ে উঠছে জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট।ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ।

হোমওয়ার্কের খাতার পাতায় আঁকা ছোট্ট পাখিটার মতো—

কত পাখি যে উড়ে চলে গেছে চিরতরে…

একটা একটা স্মৃতি যেন আজ শব্দ হয়ে ফেটে পড়ছে মনে....

সময় কোথায় চলে যায়… আর কত কিছু ফেলে রেখে যায়…

উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ দুর্ঘটনা শুধু একটি ঘটনার নাম নয়—এটা হয়ে দাঁড়িয়েছে শত শত মানুষের জীবনে এক স্থায়ী মানসিক ট্রমা। যারা হারিয়েছে সন্তান, যারা সন্তানকে আহত অবস্থায় কোলে নিয়েছে, যারা সংবাদ দেখেছে, এমনকি যারা উদ্ধার ও সেবা দিতে গিয়েছিল—প্রত্যেকেই এই ট্রমার কোনো না কোনো রূপে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা মারাত্মকভাবে রয়েছে।

মাহমুদা মহসিনা বুশরা, কোথেরাপিস্ট ও মানসিক বিষয়ক প্রশিক্ষক এবং কনসালট্যান্ট, সিটি হসপিটাল লিমিটেড।

এই দুর্ঘটনার মানসিক প্রভাব বিভিন্নভাবে দেখা দিতে পারে: অভিভাবকদের ওপর এখন যে প্রভাবগুলো লক্ষ্য করা যায়—

তীব্র মানসিক আঘাত, আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতা:

সন্তানকে হারানোর ভয় অথবা অপরাধবোধ (কেনইবা আজ স্কুলে পাঠিয়ে ছিলাম, আমি কিছু করতে পারলাম না, কেন জোর করেছিলাম স্কুলে যেতে)। চমকে ওঠা। সন্তানের ডাক শুনতে পাওয়া। অনিদ্রা, মাথাব্যথা, গা ব্যথা, ক্ষুধামান্দ্য ইত্যাদি।

 সহপাঠী ও বন্ধুদের ওপর যে প্রভাবগুলো ও লক্ষণগুলো দেখা যেতে পারে। যেমন:  দুঃস্বপ্ন, হঠাৎ কান্না, চুপচাপ হয়ে যাওয়া, স্কুলে যেতে ভয়। বমি বমি ভাব। ক্লাসে মন না বসা, নিজের প্রতি বিরক্তি, ভয়: আমার সঙ্গেও এমন হতে পারে ইত্যাদি।

যারা সরাসরি সেবা দান করছেন। যেমন: ডাক্তার, স্বেচ্ছাসেবক, উদ্ধারকর্মী। তারা যে অভিজ্ঞতাগুলোর ভেতর দিয়ে যাবে সেগুলো হলো: বারবার দুর্ঘটনার দৃশ্য চোখে ভেসে ওঠা, মানসিক ক্লান্তি, আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি (চিন্তা আসতে পারে আমি পারলাম না, আমি দক্ষ না। আমার আরও পড়াশোনা করা উচিত ছিল, তাহলে হয়তো বাঁচিয়ে রাখতে পারতাম)

 সোশ্যাল মিডিয়ায় যারা দেখছেন, তাদের ওপর যে প্রভাবগুলো পড়ছে তা হলো: তাদের মধ্যে এক ধরনের অসহায়ত্ব অনুভব করবে। প্রচুর পরিমাণে মনের অজান্তেই চোখ দিয়ে পানি পড়তে পারে। উদ্বেগ, মেজাজ খারাপ হয়ে থাকা, বিরক্তি, প্রচণ্ড এক ধরনের ভয় আঁকড়ে ধরতে পারে। আমি কি আমার বাচ্চাকে স্কুলে পাঠাব! কিন্তু কিভাবে পাঠাব? আগে তো মনে করতাম স্কুলে দিয়ে নিরাপদ থাকা যায়। অন্তত যতক্ষণ আমার ছেলেটা বা মেয়েটা স্কুলে থাকে ততক্ষণ সে নিরাপদ। আমি তো এখন তা বলতে পারছি না! বিশাল এক ধরনের অনিশ্চয়তা আতঙ্ক আচ্ছন্ন করে ফেলতে পারে।

 এই সময়টায় আমরা অনেক আবেগপ্রবণভাবে আছি। অনেকে হয়তোবা ভাবছি, কি করব! ভীষণভাবে তাদের পাশে থাকতে ইচ্ছা করছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ এই সময়টা যারা সেবায় আছেন।

আমরা যা করতে পারি:

 আমরা ভাষার প্রতি ভীষণভাবে সংবেদনশীল হব। আমরা কোন শব্দ ব্যবহার করছি, কোন ভয়েসে কথা বলছি অনেক সতর্কতার সঙ্গে করব। আমার ভাষা যেন এমপ্যাথেটিক হয়। সহানুভূতি দিতে যেয়ে এমন কোন কথা না বলে ফেলি যেটা আরও কষ্টকর হয়ে যায়। সাহায্য করতে গিয়ে কিছু শব্দ ও ভঙ্গি এড়িয়ে চলব। যেমন-

‘এইটা আল্লাহর ইচ্ছা ছিল’

‘কষ্ট তো হতেই পারে’

‘এমন তো অনেকের সঙ্গেই হয়’

‘কাঁদলে কি হবে?’

এ ক্ষেত্রে আমরা বলতে পারি-

 ‘আপনার কষ্টটা আমি অনুভব করতে পারছি।’

 ‘আপনার পাশে আছি, যতটা সম্ভব সাহচর্য দেব।’

‘এই সময়টায় আপনি একা নন। আমি আপনার সঙ্গে আছি।’

 ‘আপনার অনুভূতির জায়গাটা একদম ঠিক, এটা স্বাভাবিক।’

তা ছাড়া, যদি কেউ কিছু বলতে চায়, তবে আমি শুনতে যাব। শুধু চুপ করে শুনে যাব, কোন ধরনের ব্যাঘাত না ঘটিয়ে। চুপচাপ পাশে বসে থাকাটাও সহায়তা। অনুভূতিগুলোকে প্রকাশ করতে সহায়তা করব। তাদের কান্না, ভেঙে পড়া, আতঙ্ক সবকিছুই ‘স্বাভাবিক’—এটা বুঝিয়ে বলুন।

কাউন্সেলিং বা মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তার পরামর্শ দিন: যদি কেউ ভেঙে পড়ে বা ধকল সামলাতে না পারে, তখন সহায়তার জন্য উপযুক্ত জায়গার দিক দেখান। আপাতত যে খবরগুলো তার ভয়টাকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে, আতঙ্ক বাড়িয়ে দিতে পারে সেই খবরগুলো চোখে না পড়ানোই ভালো। পরিবারের সঙ্গে, বন্ধুর সঙ্গে, অথবা কাউন্সেলিং সেবার সঙ্গে যুক্ত করে দিন।

 আমরা যারা মিডিয়ার সঙ্গে আছি তারা নিজের মনকে জিজ্ঞেস করে খবর প্রচার করা। একটুখানি ফিরে দেখা, যদি আমি এ জায়গায় থাকতাম তাহলে আমার কেমন লাগত— এটা অনুভব করা। সঠিক খবর প্রচার করা। একটু মনে রাখা, আমার এই একটা প্রচার করার ছবি, আমার এই একটা খবর কত মানুষের জন্য ট্রমা হতে পারে। ভুল তথ্য না ছড়ানো। ব্যক্তিগত ছবি বা ভিডিও ছড়ানো থেকে বিরত থাকা।

শুধুমাত্র দায়িত্বশীল প্রতিবেদন শেয়ার করা। সহানুভূতির পোস্ট দেওয়া। বরং এই সময়টা কোথায় কিভাবে সাহায্য পেতে পারেন সেই সহায়তা করা।