
১৯৯৬ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর। শামীমা আকতার প্রতিদিনের মতো সেদিন রাতেও ঘুমাতে যাওয়ার আগে বিনুনি বাঁধেন। গুছিয়ে রাখেন পড়ার টেবিলটি। কিন্তু রাত ফুরানোর আগেই তাঁর আর্তচিৎকারে জেগে ওঠেন পরিবারের সবাই। তাঁকে নিয়ে ছুটে যান হাসপাতালে। ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়ার পরেই বোঝা গেল, অ্যাসিড–সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন সেদিনের অষ্টম শ্রেণিপড়ুয়া শামীমা। এতে তাঁর মুখ, গলা, বুকসহ শরীরের বেশির ভাগ অংশ ঝলসে গেছে। শামীমা আজও জানেন না কে সেই দুর্বৃত্ত। তবে সেদিনের ক্ষত এখনো বহন করছে তাঁর শরীর, মস্তিষ্ক বয়ে বেড়াচ্ছে দুঃসহ স্মৃতিগুলো।
শামীমা সেলাই করতে ভালোবাসেন। ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতেন ফ্যাশন ডিজাইনার হবেন। অ্যাসিড রুখতে পারেনি অদম্য শামীমার পথ চলা। তিনি এখন ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে কাজ করছেন একটি প্রতিষ্ঠানে। পাশাপাশি ঢাকার শান্ত–মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজিতে ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে পড়ছেন স্নাতকোত্তর পর্যায়ে। ঘটনার পর টানা দুই বছরে ১৪টি অপারেশন তাঁকে নিয়ে গেছে দুর্বিষহ যন্ত্রণার ভেতরে। সে সময়েই তাঁকে সামলাতে হয়েছে এলাকার মানুষের কানাঘুষা। এ ঘটনার জন্য ঘুরিয়ে–পেঁচিয়ে তারা দায়ী করত মুখের গড়ন পাল্টে যাওয়া শামীমাকেই। ফলে পড়াশোনা বন্ধ রেখে ১০টি বছর নিজেকে একরকম লুকিয়েই রেখেছিলেন তিনি।
শামীমা বলেন, ‘ভেবেছিলাম, নিয়তি আমাকে এখানেই আটকে ফেলেছে। কিন্তু প্রথম আলো আমার অন্ধকার জীবনে আবার আলোর সন্ধান দেয়।’ অ্যাসিডদগ্ধ নারীদের জন্য সহায়ক তহবিলের সহযোগিতায় ২০০৫ সালে আবার পড়াশোনা শুরু করেন শামীমা। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে ভর্তি হন কোটচাঁদপুরের একটি কলেজে।
সেলাইয়ের আনন্দে গ্রামের নির্যাতিত ও গরিব নারীদের শুরু করেন সেলাই শেখানো। গড়ে তোলেন একটি প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠান নিয়ে তাঁর স্বপ্ন আকাশছোঁয়া। পড়াশোনা শেষ করে আবার ছুটে যাবেন গ্রামে।
শামীমা বলেন, ‘এইচএসসি পাসের পর প্রথম আলোকে জানাই আমার স্বপ্নের কথা। তারা আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে পড়ার ব্যবস্থা করে। সহযোগিতা করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও। আমার স্বপ্ন আবার গতি পায়।’
গ্রামের দিনগুলো তাঁর বৈরী পরিবেশের মধ্যে কেটেছে। ভয়ে–লজ্জায় তিনি বাইরে বের হতেন না। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে সবকিছু বদলে যায়। সহপাঠীরা তাঁকে প্রথম সেমিস্টারেই আপন করে নেন। তাঁকে বোঝান, এ ঘটনায় তাঁর কোনো দায় নেই। বদলে যায় শামীমার মনোজগৎ।
ঘুরে দাঁড়িয়েছেন শামীমা। স্নাতকে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছেন। তবে গন্তব্যে পৌঁছাতে তাঁকে আরও অনেকটা পথ হাঁটতে হবে, বললেন তিনি। নিজেকে কেবল দেশে নয়, আন্তর্জাতিক পরিসরেও একজন সফল ডিজাইনার হিসেবে দেখতে চান তিনি।
শামীমার মতো মনিকা হালদারও কিশোর বয়সে অ্যাসিড–সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন। তিনিও সব বাধা–কুসংস্কার মোকাবিলা করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। এখন কাজ করছেন ব্র্যাক ব্যাংকের বরিশাল শাখায়। দুই সন্তান ও স্বামীসহ বেশ সুখেই কাটছে এই অ্যাসিডদগ্ধ নারীর জীবন।
অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তবেই এখনকার জীবনটা অর্জন করে নিয়েছেন তিনি। মুঠোফোনে কথা হচ্ছিল তাঁর সঙ্গে। বলছিলেন সেই দুঃসহ অভিজ্ঞতার কথা, ‘এসএসসি পরীক্ষার লিখিত অংশ শেষ। তাই অনেকটা ফুরফুরে মেজাজেই ছিলাম। পড়ার চাপ ছিল না। ভেবে রেখেছিলাম, সকালে উঠে ব্যবহারিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নেব।’
কিন্তু রাত পেরোনোর আগেই তাঁকে যেতে হয় হাসপাতালে। দুর্বৃত্তের ছোড়া অ্যাসিডে দগ্ধ হন কিশোরী মনিকা। ২০০১ সালের ৮ এপ্রিল পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি থানার দৈহারী গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। মনিকার মুখ, হাত, বুক ঝলসে যায়। এ সময় তাঁর মায়ের শরীরের কিছু অংশও পুড়ে যায়। স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাঁকে চিকিৎসার জন্য বিভাগীয় হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আসেন। অসহনীয় কষ্টের বিপরীতে সেদিন মনিকার মনের জোরের জয় হয়েছিল। ঠিকই ব্যবহারিক পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন তিনি। পেয়েছেন জিপিএ ৩.১৩। এরপর ভর্তি হন বরিশাল সরকারি মহিলা কলেজে। এরপর স্নাতকোত্তর শেষ করেন ঢাকার ইডেন কলেজ থেকে। শুরু থেকেই তাঁর চিকিৎসা, পড়াশোনা ও চাকরিপ্রাপ্তিতে সহায়তা করে ‘অ্যাসিডদগ্ধ নারীদের জন্য প্রথম আলো সহায়ক তহবিল’। চাকরিপ্রাপ্তিতে ব্র্যাক ব্যাংক সহায়তা করে। এ ছাড়া শামীমা ও মনিকা উভয়ের চিকিৎসায় সাহায্য করেছে অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশন।
প্রথম আলোর সাংবাদিকদের এক দিনের বেতন দিয়ে ২০০০ সালের ১৯ এপ্রিল অ্যাসিডদগ্ধ নারীদের জন্য প্রথম আলো সহায়ক তহবিলের যাত্রা শুরু। মূলত তহবিলটি চলছে প্রথম আলোর পাঠক ও শুভানুধ্যায়ীর আর্থিক সহযোগিতায়। এর মধ্যে যেমন আছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যবসায়ী, করপোরেট প্রতিষ্ঠানের কর্মী, তেমনি আছে স্কুলপড়ুয়া ছোট্ট ছেলেমেয়ে কিংবা গার্মেন্টস কর্মীও। অ্যাসিড-সন্ত্রাসের শিকার নারীদের পুনর্বাসন, চিকিত্সা ও আইনি সহায়তা দিয়ে তাঁদের জমি, ঘর, দোকান, গবাদিপশু, ট্রলার দেওয়ার মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করা হয় এই তহবিলের মাধ্যমে। সহযোগিতা পেয়েছেন: ৪৫০ জন নারী