বৃত্তি নিয়ে ইউরোপে রায়গঞ্জের সুজন

ফ্রান্সের ইউনিলাসাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে অদম্য মেধাবী সুজন কুমার ভাদুড়ী।
ছবি: সংগৃহীত

সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার হাটপাঙ্গাসী বাজারের একটি কাপড়ের দোকানের সামনে সেলাই মেশিন চালান বাবুল কুমার ভাদুড়ী। সেলাইয়ের আয়েই দুই ছেলে–মেয়ে নিয়ে চলছিল তাঁর সংসার। ছেলে সুজন কুমার ভাদুড়ী বরাবরই স্কুলে ভালো ফল করে আসছিল। অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করে এসএসসিতেও সুজন জিপিএ–৫ ফল নিয়ে এল। এরপরও আশার আলো খুঁজে পাচ্ছিলেন না বাবুল ভাদুড়ী। নিত্য টানাটানির সংসারে থাকা এই বাবা কেবল বেঁচে থাকার যুদ্ধটাই জানতেন। ছেলেকে নিয়ে বড় স্বপ্ন দেখার অবস্থাও তখন তাঁর নেই। এ পরিস্থিতিতেই স্থানীয় এক শিক্ষকের সহায়তায় পরিবারটিকে খুঁজে পায় প্রথম আলো। সুজন পান ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তি। বৃত্তির অর্থে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করেন তিনি। সেই অদম্য মেধাবী সুজন চলতি বছর ইউরোপীয় ইউনিয়নের মর্যাদাপূর্ণ ইরাসমাস মুন্ডুস বৃত্তি পেয়েছেন। এই বৃত্তি নিয়ে এ বছর তিনি ‘মাস্টার্স প্রোগ্রাম ইন প্ল্যান্ট ব্রিডিংয়ে’ ফ্রান্সের ইউনিলাসাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেছেন। পরের বছর একই বিষয়ে তিনি ফিনল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব হেলসিংকিতে পড়বেন।

ইছামতীর পারের শান্ত-সবুজ গ্রাম হাটপাঙ্গাসী। বাবা বাবুল কুমার ভাদুড়ী ও মা মনিকা রানী ভাদুড়ীর দুই ছেলে–মেয়ের মধ্যে সুজন বড়। গ্রামের আর দশটা ছেলেমেয়ের সঙ্গে হাটপাঙ্গাসী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সুজনের পড়াশোনা শুরু। এরপর ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন স্থানীয় লায়লা-মিজান স্কুল অ্যান্ড কলেজে। মেধাবী বলে শুরুতেই নজর পড়ে শিক্ষকদের। তাঁর পড়াশোনার নিয়মিত খোঁজখবর রাখতেন ওই স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক রণজিৎ কুমার সেন। শিক্ষকেরা শুরু থেকেই সুজনকে নিয়ে আশাবাদী ছিলেন। ২০১১ সালে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পান সুজন। এইচএসসিতে পড়াশোনার খরচ নিয়ে পরিবারের শঙ্কা ছিল। এর মধ্যেই ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তি পান সুজন। সেই অর্থে ভর্তি হন বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিজ্ঞান বিভাগে। সেখান থেকে এইচএসসিতেও জিপিএ-৫।

এরপর ভর্তি হলেন দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বিভাগে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে লেখাপড়ার পাশাপাশি নানা কার্যক্রমেও নিজেকে যুক্ত করেন সুজন। প্রথম আলো বন্ধুসভা দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শাখায় ২০১৮-১৯ সালে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সেখান থেকে স্নাতক (বিএসসি) শেষ করে স্নাতকোত্তরে পড়া অবস্থাতেই বৃত্তি নিয়ে গত ১০ সেপ্টেম্বর ইউরোপ পাড়ি জমিয়েছেন সুজন।

সুজন কুমার ভাদুড়ী বলেন, ‘আমার জীবনে আলোকবর্তিকা হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিল ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তি। এই বৃত্তি না পেলে উচ্চমাধ্যমিক থেকে বিএসসি অনার্স সম্পন্ন করা সম্ভব হতো না।’

সুজন বলেন, স্নাতক শেষ করে জেনেটিকস অ্যান্ড প্ল্যান্ট ব্রিডিং ডিপার্টমেন্টে স্নাতকোত্তরে (মাস্টার্স) ভর্তি হন। সবাই যখন চাকরির প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত, তখন তিনি ভালো বৃত্তির খোঁজ করেছেন। করোনার কারণে দীর্ঘ চার মাস বাড়িতে থাকার সময় অবশ্য হতাশা গ্রাস করেছিল। ঠিক তখনই পেলেন জীবনের অন্যতম সেরা সুখবরটি। তিনি ইরাসমাস মুন্ডুস বৃত্তি পেতে যাচ্ছেন।

প্রথম আলো ট্রাস্টের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সুজন বলেন, ‘আমরা যারা অন্যের সাহায্য নিয়ে বড় হয়েছি, তারা যেন জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর নিজেদের হাতটা অপরের সাহায্যের জন্য বাড়িয়ে দিই। সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের ভালো কিছু করার সুযোগ করে দিতে পারি।’

ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্টের অদম্য মেধাবী কার্যক্রমের আওতায় প্রতিবছর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের ফলের ওপর ভিত্তি করে যথাক্রমে উচ্চমাধ্যমিক এবং স্নাতক শ্রেণিতে শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হয়। প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে তাঁদের নির্বাচন করেন। অদম্য মেধাবী তহবিলের আওতায় এ পর্যন্ত ৯৪২ শিক্ষার্থী বৃত্তি পেয়েছেন। এর মধ্যে ব্র্যাক ব্যাংকের সহায়তায় ৭১৮ জন, অন্যান্য ব্যক্তি ও দাতা সংস্থার সহায়তায় ২২৪ জনকে বৃত্তি দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে বৃত্তি পাচ্ছেন ২৭১ শিক্ষার্থী। স্নাতক পর্যায়ে বৃত্তিপ্রাপ্ত ২২১ জনের মধ্যে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০৭, মেডিকেল কলেজে ১৯, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩২, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫৫ ও দরিদ্র কোটায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন।