দড়ি হাইরমারা গ্রামে ভরসার নাম সাদত স্মৃতি পল্লী

গত ২৩ মে এক যুগ পূর্তি করল প্রথম আলো ট্রাস্ট। গত ১২ বছরে প্রথম আলো ট্রাস্ট সামাজিক উন্নয়নমূলক নানাধর্মী কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। সার্বিক কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত বিষয়গুলো নিয়ে সাত দিন থাকছে সাতটি ধারাবাহিক পর্ব। আজ থাকছে প্রথম আলো ট্রাস্ট-সাদত স্মৃতি পল্লী নিয়ে শেষ পর্ব

নরসিংদীর রায়পুরার দড়ি হাইরমারা গ্রামে সাদত স্মৃতি পল্লী প্রকল্পে প্রায় এক হাজার বইসমৃদ্ধ একটি লাইব্রেরি স্থাপন করা হয়েছে। শিশুরা লাইব্রেরিতে পড়ছে। করোনার আগে তোলা ছবি।
ছবি: প্রথম আলো

রোকেয়া বেগম (৫০) নরসিংদীর খোদাদিলা গ্রাম থেকে এসেছেন মাইকে বিনা মূল্যে চক্ষুশিবিরের কথা শুনে। তাঁর ছেলেরা মাটির কাজ (ইটভাটায়) করেন। স্বামী অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। তাঁরও চোখে ছানি পড়ায় কয়েক বছর ধরে চোখে ঝাপসা দেখেন। অভাবের সংসারে চোখের অপারেশন করানোর সামর্থ্য নেই। তিনি এসেছিলেন বিনা মূল্যে চোখের ডাক্তার দেখাতে। তাঁর মতো এমন শতাধিক চোখের সমস্যায় আক্রান্ত রোগীকে বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা দিতে ২০১৮ সালে প্রথম আলো ট্রাস্টের উদ্যোগে দিনব্যাপী নরসিংদীর রায়পুরার দড়ি হাইরমারা গ্রামের সাদত স্মৃতি পল্লীতে চক্ষুশিবিরের আয়োজন করা হয়। এনভয় গ্রুপের চেয়ারম্যান কুতুবউদ্দিন আহমেদের ব্যক্তিগত সহযোগিতায় চক্ষুশিবিরটি আয়োজন করা হয়। চক্ষুশিবির থেকে চিকিৎসক দল ৩৫ জনকে প্রাথমিকভাবে বাছাই করে। তাঁদের মধ্য থেকে জরুরি ভিত্তিতে ১৮ জনকে বিনা মূল্যে চোখের ছানি অপারেশনের জন্য মনোনীত করা হয়। পরে চূড়ান্তভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ১২ জনকে ফ্যাকো মেশিনের মাধ্যমে চোখের অপারেশন করা হয়। অপারেশন শেষে তাঁদের প্রত্যেককে নিজ গ্রামে পৌঁছে দেওয়া হয়। তাঁদের প্রত্যেককে ব্যবস্থাপত্র, ওষুধ, চশমাসহ আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম প্রদান করা হয়।

চক্ষুশিবিরের চিকিৎসক মো. আরশাদ উদ জামান বলেন, ‘চোখের চিকিৎসা ব্যয়বহুল হওয়ায় প্রত্যন্ত এই এলাকার লোকেদের জন্য এটি একটি সুযোগ। চক্ষুরোগ চিকিৎসা বিষয়ে তাঁদের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে। রোগীদের মধ্যে বেশির ভাগের চোখে ছানি ও ইনফেকশনের সমস্যা পেয়েছি। কারও কারও চোখে ছিল মাংস বৃদ্ধির সমস্যা।’ এই অপারেশন পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ আই ট্রাস্ট হসপিটাল ৬ জন চিকিৎসকের সমন্বয়ে একটি বোর্ড গঠন করেছিল।

প্রথম আলো ট্রাস্টের অন্যতম একটি প্রকল্প সাদত স্মৃতি পল্লী। নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার দড়ি হাইরমারা গ্রামে প্রকল্পটি অবস্থিত। এনভয় গ্রুপের চেয়ারম্যান কুতুবউদ্দিন আহমেদের ব্যক্তিগত সহায়তায় প্রথম আলো ট্রাস্ট প্রকল্পটি পরিচালনা করছে। প্রকল্পে নিয়মিতভাবে গ্রামের অসহায় দরিদ্র মানুষকে বিনা মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়। সপ্তাহে ২ দিন ৩ জন চিকিৎসক দ্বারা এই চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়ে থাকে। সপ্তাহে ১০৫ জন রোগী এই সেবা পান। প্রতি মাসে মোট ৬০ জন বয়স্ক ব্যক্তিকে প্রতি মাসে ১ হাজার টাকা করে ভাতা দেওয়া হয়। এ অঞ্চলের শিশু–কিশোর ও যুবকদের পাঠের অভ্যাস এবং জ্ঞানচর্চার জন্য লাইব্রেরি স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে প্রায় দেড় লাখ টাকার বই রয়েছে। দিন দিন পাঠক বাড়ছে। করোনার সময়ে যদিও এই কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। কিন্তু অবিলম্বে এই কার্যক্রম আবার চালু করা হবে। শিশুরা তখন লাইব্রেরিতে না পড়ে বই বাসায় নিয়ে পড়ে আবার নির্দিষ্ট সময় পর ফেরত দিয়ে নতুন বই নিতে পারে।

ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী রোগীদের বিনা মূল্যে ওষুধ বিতরণ করা হচ্ছে। করোনার আগে তোলা ছবি।
ছবি: প্রথম আলো

এ ছাড়া সাদত স্মৃতি পল্লী প্রকল্পে শিশুবিকাশ কেন্দ্র করা হয়েছে। এই কেন্দ্রে শিশুদের নৈতিক শিক্ষা, বাংলার সংস্কৃতি, সাংস্কৃতিক ও প্রযুক্তিবিষয়ক শিক্ষা প্রদান করা হয়। বর্তমানে শিক্ষার্থী সংখ্যা ৫২। সপ্তাহে দুই দিন—বৃহস্পতি ও শুক্রবার শিশুবিকাশের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। গ্রামের শিশুদের মানসিক বিকাশের লক্ষ্যে গল্পের বই পড়ে অভ্যাস, ছবি আঁকা ও নৈতিক শিক্ষাবিষয়ক ক্লাস নেওয়া হয়। কম্পিউটার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও আছে। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে যেকোনো ক্লাসের শিক্ষার্থীরাই কম্পিউটার প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে। এখানে কম্পিউটার পরিচালনা, অফিস ম্যানেজমেন্ট, এক্সেল ও গ্রাফিকসের কাজ শেখানো হয়। যদিও করোনা পরিস্থিতির কারণে শিশুবিকাশ কেন্দ্রের কার্যক্রম আপাতত বন্ধ।

গ্রামের শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য ‘আরজান-আরিশ’ শিশুপার্ক স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিদিন আশপাশের বিভিন্ন এলাকার ছেলেমেয়েরা খেলতে আসে। ৫০ থেকে ৭০ জন শিশু খেলতে আসে। অনেক শিশুর সঙ্গে অভিভাবকেরাও আসেন। শিশুপার্কটি খেলার জন্য বেলা ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত উন্মুক্ত থাকে। প্রতি সোমবার পার্কটি বন্ধ থাকে। পার্কের নিরাপত্তার জন্য আছেন দুজন নিরাপত্তাকর্মী। তবে করোনা মহামারির কারণে পার্কটি আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে শিশুদের জন্য এটি আবার খুলে দেওয়া হবে।

স্বাস্থ্যসেবা নিতে আসা রোগীরা লাইনে দাঁড়িয়ে টোকেন সংগ্রহ করছেন।করোনার আগে তোলা ছবি।
ছবি: প্রথম আলো

করোনার আতঙ্কের সময়টা যেন আমরা সামলে উঠতে পারি। তাহলে এসব অসহায় মানুষকে চিকিৎসাসেবা আবার নিয়মিত হবে। গ্রামের শিশু-কিশোরদের সাংস্কৃতিক চর্চা, শারীরিক ও মানসিক বিকাশের নিরাপদ স্থান সাদাত পল্লি আবার মুখর হোক গ্রামের মানুষের পদচারণে। প্রকল্পে আবার ছেলেমেয়েদের আনন্দে ভরা গানের সুর ভেসে বেড়াক। এটা আমাদের প্রত্যাশা।

উল্লেখ্য, এনভয় গ্রুপের চেয়ারম্যান কুতুবউদ্দিন আহমেদের ব্যক্তিগত আমন্ত্রণে ২০১৪ সালের ১৯ জুলাই প্রথম আলো ট্রাস্টের একটি কমিটি প্রকল্পটি পরিদর্শন যান। পরবর্তী সময়ে ২০১৫ সালে সেপ্টেম্বরে প্রকল্পে সমন্বয়কারী নিয়োগ দিয়ে প্রাথমিকভাবে কার্যক্রম শুরু করা হয়।


লেখক: সমন্বয়ক, প্রথম আলো ট্রাস্ট।