মাথার চুল ধবধবে সাদা। সেটাও ছোট করে ছাঁটা। মুখমণ্ডলের ভাঁজে ভাঁজে বয়সের ছাপ স্পষ্ট। বয়সের ভারে একেবারে নুয়ে পড়েছেন। একটি বাঁশের লাঠিই এখন তাঁর একমাত্র ভরসা। সেই লাঠির ওপর ভর করে এগিয়ে এলেন গঙ্গামনী (৮০)। প্রথম আলো বন্ধুসভার সদস্যরা তাঁর হাতে একটি কম্বল ধরিয়ে দিলেন। গঙ্গামনী বললেন, ‘আগত কতটে গেইছু, হামাক কাহে কম্বল দেয়নি। জাড়ত দর দর করিয়া কাঁপিছিনু। তোমরা মোক কম্বল দিয়া জাড়ত থাকিয়া বাঁচাইলেন। আইজ শান্তিত নিন্দাবা পারিমু।’
প্রথম আলো ট্রাস্টের উদ্যোগে কম্বল পেয়ে আজ রোববার এভাবেই নিজের অনুভূতি জানান ঠাকুরগাঁওয়ের সদর উপজেলার কান্দরপাড়া গ্রামের গঙ্গামনী। আজ মোট ২০০ শীতার্ত মানুষের মধ্যে কম্বল বিতরণ করেন প্রথম আলো বন্ধুসভার সদস্যরা। এর মধ্যে বিকেলে উপজেলার শিকদারহাট উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে আউলিয়াপুর ইউনিয়নের ১২০ জনকে ও সকালে শহরের সাধারণ পাঠাগার চত্বরে পৌর এলাকার ৮০ জনকে কম্বল দেওয়া হয়।
এ ছাড়া পঞ্চগড় সদর উপজেলার রাজারপাঠ ডাঙ্গা আশ্রয়ণ প্রকল্পসংলগ্ন ঈদগাহ মাঠে ১২০ জনকে কম্বল দেওয়া হয়। এ ছাড়া পঞ্চগড় শহরসহ আরও কয়েকটি স্থানে ৮০টি কম্বল বিতরণ করা হয়।
গত বৃহস্পতি, শুক্র ও গতকাল শনিবার বন্ধুসভার সদস্যরা ঠাকুরগাঁও পৌর শহরের বিভিন্ন মহল্লা ও সদর উপজেলার আউলিয়াপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের শীতার্ত মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ‘কম্বল বিতরণ স্লিপ’ তুলে দেন।
আজ সকালে শহরের সাধারণ পাঠাগার চত্বরে কম্বল বিতরণের আয়োজনে প্রধান অতিথি ছিলেন ঠাকুরগাঁও মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ আবু বক্কর সিদ্দিক। এ সময় ঠাকুরগাঁও প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক লুৎফর রহমান, প্রথম আলো ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি মজিবর রহমান খান, বন্ধুসভার সভাপতি ফরহাদুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক লায়লা ফেরদৌস প্রমুখ বক্তব্য দেন।
প্রথম আলো ট্রাস্টের দেওয়া কম্বল বুকে চেপে ধরে ভাতগাঁও গ্রামের বৃদ্ধা দিনেশ্বরী (৭০) বলেন, ‘রাইতত কঠিন শীত পড়ছে। শীতত খুব কষ্ট পাচ্চি। কম্বলডা গাওত দিয়া আরামে নিন (ঘুম) যাবা পারমো। আর জাড় আর লাগিবেনি।’
এক মাসের ছেলেকে কোলে নিয়ে কম্বল নিতে এসেছেন মাদারগঞ্জ গ্রামের পুতুল রানী (৩৪)। এ সময় তিনি বলেন, গরম কাপড়ের কারণে শীতে বাচ্চাটা কষ্ট পাচ্ছিল। কম্বল পেয়ে খুব উপকার হলো।
সকালে সাধারণ পাঠাগার চত্বরে কম্বল বিতরণের সময় পৌর শহরের কালীবাড়ি এলাকার মতিউর রহমান (৬৫) জানান, তিনি গোদরোগে ভুগছেন। রাতে শীতে পা ঠান্ডা হয়ে আছে। গরম কাপড়ের অভাবে শীতে খুব কষ্টে ছিলেন তিনি। কম্বলটা পেয়ে আজ তাঁদের কষ্ট দূর হলো।
পঞ্চগড় সদর উপজেলার ধাক্কামারা ইউনিয়নের রাজারপাঠ ডাঙ্গা আশ্রয়ণ প্রকল্পসংলগ্ন ঈদগাহ মাঠে সকালে জড়ো হন শতাধিক নারী-পুরুষ। নদীবেষ্টিত বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো এই আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দাদের জন্য কম্বল নিয়ে সেখানে হাজির হন পঞ্চগড়ের প্রথম আলো বন্ধুসভার সদস্যরা। আশ্রয়ণ প্রকল্পে বসবাসকারী ১২০টি পরিবারের একজন করে বসানো হয় সারিবদ্ধভাবে। উপস্থিত সবাইকে পরিয়ে দেওয়া হয় মাস্ক। এরপর প্রত্যেকের হাতে তুলে দেওয়া হয় একটি করে কম্বল।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আজাদ জাহান, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আরিফ হোসেন, প্রথম আলোর পঞ্চগড় প্রতিনিধি রাজিউর রহমান, পঞ্চগড়ের প্রথম আলো বন্ধুসভার সভাপতি রাশিদ আল শিহাব চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক নওরিন জাহান নূপুর প্রমুখ।
কম্বল পেয়ে আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা রহিমা বেগম (৫৮) বলেন, ‘রাইতোত শীল শীল বাতাসখানোত হাত-পাও লা ককড়া হয় আসেছে, জাড়তে শান্তিমতো ঘুমাও যায় না। কম্বলডা পায়া একটু হইলেও জাড়খান পালাবে বাপু।’
পরে দুপুরে বন্ধুসভার সদস্যরা কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পঞ্চগড় বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম রেলওয়ে স্টেশন, পঞ্চগড় শহরের জালাসী, মসজিদপাড়া, রামের ডাঙ্গা, রাজনগর, কায়েতপাড়া ও সদর উপজেলার হাঁড়িভাসা এলাকায় গরিব ও দুস্থ মানুষের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ৮০টি কম্বল বিতরণ করেন।
এভাবেই রোববার দিনভর প্রথম আলো ট্রাস্টের দেওয়া ২০০টি কম্বল বিতরণ করেন বন্ধুসভার সদস্যরা।
রেলস্টেশন এলাকায় কম্বল দেওয়া হয় সফিকুল ইসলামকে (৬৫)। তিনি বলেন, তিনি দেখতে পান না। মানুষের কাছে হাত পেতে খান। ঠান্ডায় কাবু হয়ে পড়েছেন। শীতের দিনে কম্বলটা বড় উপকারে আসবে।
শীতার্তদের পাশে দাঁড়াতে এগিয়ে আসতে পারেন আপনিও। সহায়তা পাঠানো যাবে ব্যাংকের মাধ্যমে। হিসাবের নাম: প্রথম আলো ট্রাস্ট/ত্রাণ তহবিল, হিসাব নম্বর: ২০৭ ২০০ ১১১৯৪ ঢাকা ব্যাংক লিমিটেড, কারওয়ান বাজার শাখা, ঢাকা।