খালিদ রেজা। সাভারে ধসে যাওয়া রানা প্লাজার ৭ম তলায় নিউওয়েভ স্টাইল গার্মেন্টসে প্রোডাকশন ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতেন তিনি। রানা প্লাজা ধসে ডান হাত ও ডান পা ভেঙে গুরুতর আহত হয়েছিলেন খালিদ রেজা। চিকিৎসা করেও পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে পারেননি।
ভবনধসের পর বিজিএমইএ থেকে দেওয়া মজুরি, ক্ষতিপূরণ ও সিআরপির অনুদান পান। এদিকে মেরিল-প্রথম আলো সাভার সহায়তা তহবিল থেকে ১ লাখ টাকা অনুদান পান তিনি। সেই অর্থ দিয়ে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে রামপুরায় কাপড়ের ব্যবসা শুরু করেন। বর্তমানে তাঁর দোকানের সংখ্যা ৩। খালিদ রেজার মতো ১০১ জনকে মেরিল-প্রথম আলো সাভার সহায়তা তহবিল থেকে সহায়তা করা হয়।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিলে ঘটে যাওয়া শতাব্দীর ভয়াবহতম ভবন বিপর্যয় সাভারের রানা প্লাজা ধসে এক হাজার ১৩৪ পোশাককর্মী নিহত হন। ভবনটিতে কর্মরত মোট তিন হাজার ৬৩৯ জন শ্রমিকের মধ্যে আহত হন দুই হাজার ৪৩৯ জন এবং এখনো নিখোঁজ ১১৬ জন। ঘটনার প্রথম দিন থেকেই প্রথম আলো ট্রাস্টের পক্ষ থেকে বন্ধুসভা ওষুধ ও সরঞ্জাম নিয়ে ঘটনাস্থল ও হাসপাতালগুলোতে কাজ শুরু করেন। ২৬ এপ্রিল পূর্বনির্ধারিত মেরিল-প্রথম আলো অনুষ্ঠানে ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বিকেল থেকেই ছিল শোকের পরিবেশ। ওই দিনের অনুষ্ঠানটিকে সাভার দুর্গতদের জন্য উৎসর্গ করা হয়। তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত হয় একটি সহায়তা তহবিল গঠনের। প্রথম আলোর সাংবাদিক ও কর্মীদের এক দিনের বেতনের টাকা দিয়ে তহবিল শুরু হয়। এরপর স্কয়ার টয়লেট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী ঘোষণা করেন ১০ লাখ টাকা অনুদানের কথা। ওই অনুষ্ঠানেই শিল্পী ও কলাকুশলীদের অনুদান যোগ হয়ে মোট ৫৪ লাখ টাকা দিয়ে 'মেরিল-প্রথম আলো সাভার সহায়তা তহবিল' গঠিত হয়। পরে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ তহবিলে সহায়তা প্রদান করেন। তহবিলে জমা পড়া অর্থ দিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহায়তা, চিকিত্সা, শিক্ষাবৃত্তি ইত্যাদি ক্ষেত্রে সহায়তা করা হয়েছে।
রানা প্লাজায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসনের জন্য এ তহবিল গঠন করা হয়। এই তহবিলের মাধ্যমে তাত্ক্ষণিকভাবে দুর্ঘটনায় পতিত এবং আহত ব্যক্তিদের জন্য খাবার, স্প্রে, অক্সিজেন ও পানি সরবরাহ করা হয়। আহত ব্যক্তিদের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিত্সার ব্যবস্থা করা হয়। পরবর্তীতে, গুরুতর আহত ব্যক্তিদের মধ্য থেকে পুনর্বাসনের জন্য ১০০ জনকে ১ লাখ করে এবং একজনকে ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। এ ছাড়া রানা প্লাজায় নিহত ব্যক্তিদের ২০ জনের সন্তানদের শিক্ষা বৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। প্রথম শ্রেণি থেকে স্নাতকোত্তর পর্ব পর্যন্ত এই সহায়তা দেওয়া হবে।
রানা প্লাজায় একটি পোশাক কারখানায় কোয়ালিটি পরিদর্শক হিসেবে কাজ করতেন ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী আল আমিন। তাঁর বাড়ি রংপুরের বদরগঞ্জে। ওই দুর্ঘটনায় আহত হয়ে তাঁর পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। এই তহবিল থেকে অর্থ-সহায়তা পেয়ে আল আমিন মাস্টার্স পাস করেছেন। আল আমিন বলেন, ‘এই অনুদান আমাকে দারুণভাবে সহযোগিতা করেছে। টাকার অভাবে আমি পড়ালেখা ছেড়েই দিতাম। এখন লেখাপড়া শেষে আমি নিজের স্বপ্ন পূরণের চেষ্টা করছি।
খালিদ রেজা বলেন, প্রথম আলো ট্রাস্টের দেওয়া অনুদানে গত ৮ বছরে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। আর্থিকভাবে ভালো আছি।
দিনমজুর বাবা আর পোশাকশ্রমিক মায়ের উপার্জনে চলছিল মাহিয়ার পড়ালেখা। রানা প্লাজা ধসে মাকে হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়ে পরিবারটি। বন্ধ হয়ে যায় চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী মাহিয়ার স্কুলে যাওয়া। তবে মেরিল-প্রথম আলো সাভার সহায়তা তহবিলের শিক্ষাবৃত্তি পেয়ে আবার পড়াশোনা করছে।
রানা প্লাজার একটি কারখানায় কাজ করতেন কুমিল্লার ইয়াকুব আলী। ওই দুর্ঘটনায় তাঁর ডান হাত, ডান পা এবং ডান পাশের পাঁজর ভেঙে যায়। শারীরিক জটিলতায় কাজ করতে পারেন না। তবে মেরিল-প্রথম আলো সাভার সহায়তা তহবিলের অনুদানে তিনি একটি মুদিদোকান দিয়েছেন। ইয়াকুব বলেন, ‘গত ৮ বছরে কেউ আমাদের খোঁজ নেয়নি। কী অবস্থায় আছি কেউ জানতেও চায়নি। এই অনুদান পেয়ে আমরা কৃতজ্ঞ।’
পাবনার বাদাল বীণাপাণি এসসি উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শারমিন আক্তার বলে, ‘কখনো ভাবতে পারিনি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারব। এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। আরও পড়ালেখা করতে চাই।’
ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনায় সাবিনার ডান পাঁজরের হাড় ভেঙেছিল। কর্মক্ষম সাবিনা আর পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি। এখনো তাঁকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে দুঃসহ স্মৃতি ও শারীরিক জটিলতা। নিরুপায় সাবিনাকে দেওয়া হয় অনুদান। সেই টাকা দিয়ে সাবিনা জমি বর্গা নেন। বর্গা জমির ধান বিক্রি করা টাকা এখন তিনি পরিবারকে দিচ্ছেন। সাবিনা বলেন, ‘এই সহযোগিতা না পেলে আমি ধুঁকে ধুঁকে মরে যেতাম।’
একটু ভালো থাকার আশায় ঢাকায় এসেছিলাম ভাই-ভাবির সঙ্গে। বড় ভাই, ভাবি ও ভাবির গর্ভের শিশুকে হারালাম এই গার্মেন্টসের জন্য। আর আমি সারা জীবনের মতো পঙ্গু হলাম, জীবনে আর কখনো গার্মেন্টসের নাম নেব না। এভাবেই নিজের কথা বললেন রানা প্লাজা ধসে আহত আঙ্গুরা খাতুন। মেরিল-প্রথম আলো সাভার সহায়তা তহবিল থেকে আঙ্গুরা খাতুনকে এক লাখ টাকা সহায়তা দেওয়া হয়। আঙ্গুরা খাতুন একা চলতে পারেন না। তাঁর বাঁ হাত পুরোটা অকেজো হয়ে গেছে। মাথার আঘাত নিয়মিত যন্ত্রণা দেয়। স্বামী আবদুল হান্নান পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। এ ঘটনার পর তিনি সিরাজগঞ্জের নিজ গ্রামে চায়ের দোকান দিয়ে জীবন পার করার যুদ্ধ করছেন।
রোকেয়া খাতুন একা চলতে পারেন না। অসুস্থ রোকেয়া ও দুই বছরের মেয়েকে রেখে স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। অসহায় রোকেয়া বলেন, বৃদ্ধ বাবা আর পাঁচ বোনের সংসারে বোঝা হয়ে আছি। তিনি বলেন, এই এক লাখ টাকা আমার কাছে এক কোটি টাকার সমান, এ টাকা দিয়ে আমার মেয়েকে মানুষ করব।