ওরা পড়ছে, স্বপ্ন দেখছে

ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ২০ শিক্ষার্থী পাচ্ছে মেরিল-প্রথম আলো সাভার সহায়তা তহবিলের শিক্ষাবৃত্তি। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ছে ওরা।

দুই ভাইবোন হাসান মাহমুদ ও ফারজানা আক্তার। রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় বাবাকে হারিয়ে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। মেরিল–প্রথম আলো সাভার সহায়তা তহবিল থেকে শিক্ষাবৃত্তি পেয়ে ওরা পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। গতকাল রাজধানীর মহাখালীতে।
ছবি : হাসান রাজা

সাভারে রানা প্লাজার একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন ময়না বেগম। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা দুর্ঘটনার ১৫ দিন পর তাঁর লাশ উদ্ধার করা হয়। ময়নার একমাত্র মেয়ে মাহিয়া তখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ত। মায়ের আয়েই তার পড়াশোনা চলত।

মাহিয়ার বাবা মনির হোসেন দিনমজুর। তাঁর পক্ষে মাহিয়াকে স্কুলে পাঠানো কঠিন হয়ে পড়ে। এ সময় এগিয়ে আসে প্রথম আলো ট্রাস্ট। এ ট্রাস্টের অধীনে পরিচালিত মেরিল-প্রথম আলো সাভার সহায়তা তহবিলের শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হয় মাহিয়াকে। সে এখন বরিশালের উজিরপুর উপজেলার সরকারি শেরেবাংলা ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী।

মাহিয়ার বাবা মনির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার অনেক ঋণ ছিল। কোনোভাবেই মেয়ের পড়াশোনা চালাতে পারছিলাম না। আমার মেয়ে পড়াশোনায় যতটুকু এগিয়েছে, তা সম্ভব হয়েছে এ সহায়তার কারণে। মেয়েকে আমি বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়াতে চাই।’ তিনি জানান, প্রতি মাসে মাহিয়া পড়াশোনার ব্যয় বাবদ দুই হাজার করে টাকা পায়।

শিক্ষাবৃত্তি পেয়ে বাগেরহাটের পাপিয়া আক্তার দশম, রংপুরের মেহেদী হাসান নবম, মানিকগঞ্জের মৃদুল হোসেন অষ্টম ও মাহবুবা রহমান দশম শ্রেণিতে পড়োশোনা করছে–প্রথম আলো

রানা প্লাজা ধসে প্রাণ হারিয়েছিলেন অন্তত ১ হাজার ১৩৬ জন, যাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন পোশাক কারখানার শ্রমিক। এ দুর্ঘটনা শুধু স্বজন হারানোর বেদনা নয়, বহু পরিবারে নিয়ে আসে বহুমাত্রিক সংকট। সবচেয়ে বড় সংকটে পড়ে মা-বাবা হারানো শিশুরা, যাদের অনেকের পড়াশোনা বন্ধের উপক্রম হয়। তবে একটু সহায়তা যে অনেকের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে, তা প্রমাণিত হয়েছে মেরিল-প্রথম আলো সাভার সহায়তা তহবিলের শিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে।

রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত পোশাকশ্রমিক এবং কর্মচারীদের ২০ জনের সন্তানকে এ তহবিলের অধীনে শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। এখন ওরা পড়াশোনা করছে, এগিয়ে যাচ্ছে নিজেদের স্বপ্নপূরণের পথে।

শিক্ষাবৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে রয়েছে বরিশালের দুই ভাইবোন হাসান মাহমুদ ও ফারজানা আক্তার। হাসান হতে চায় ব্যাংক কর্মকর্তা, আর ফারজানা হতে চায় চিকিৎসক। হাসান ও ফারজানার বাবা ফোরকান হাওলাদার রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় মারা যান। হাসান মেরিল-প্রথম আলো সাভার সহায়তা তহবিলের আওতায় ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে বৃত্তি পাচ্ছে। সে এখন গুলশান কমার্স কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। ফারজানা পড়ছে মহাখালীর টিঅ্যান্ডটি আদর্শ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণিতে।

হাসান ও ফারজানার মা জেসমিন বেগম দুই সন্তানকে নিয়ে এখন মহাখালীতে থাকেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সহায়তা না পেলে সন্তানদের লেখাপড়া করাতে পারতাম না। আমি নিজে অসুস্থ। বাড়িতে সেলাইয়ের কাজ করে সংসার চালাই। ওদের লেখাপড়া হচ্ছে বৃত্তির টাকায়।’

খুলনার রেদোয়ান হোসেন ফিন্যান্সে স্নাতক করছেন। হাসান ইমাম করছেন ডিপ্লোমা। এ ছাড়া বরিশালের মাহিয়া উজিরপুর উপজেলার সরকারি শেরেবাংলা ডিগ্রি কলেজে একাদশ ও গোপালগঞ্জের খাদিজা আক্তার দশম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে–প্রথম আলো

রানা প্লাজা ধসের দুদিন পর ২০১৩ সালের ২৬ এপ্রিল ‘মেরিল-প্রথম আলো সাভার সহায়তা তহবিল’ গঠিত হয়। ওই দিন পূর্বনির্ধারিত মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার, ২০১৩–এর অনুষ্ঠানটি উৎসর্গ করা হয়েছিল রানা প্লাজা ধসে দুর্গত ব্যক্তিদের।

অনুষ্ঠানস্থলেই রানা প্লাজা দুর্ঘটনার ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার জন্য তহবিল সংগ্রহ করা শুরু হয়। এতে বিভিন্ন অঙ্গনের শিল্পী ও কলাকুশলীরা অনুদান দেন। মোট ৫৪ লাখ টাকা নিয়ে এ তহবিল যাত্রা শুরু করে। পরে সহায়তা করেন সমাজের সব স্তরের মানুষ।

সব মিলিয়ে সাভার সহায়তা তহবিলে বিভিন্ন সময়ে জমা হয় প্রায় ২ কোটি ২৪ লাখ টাকা। এর থেকে প্রায় ৭১ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয় হয় উদ্ধারকাজ এবং চিকিৎসায়। ১ কোটি ৫০ হাজার টাকা খরচ হয় ক্ষতিগ্রস্ত ১০১ জন মানুষের পুনর্বাসন সহায়তায়।

আর তহবিলের বাকি টাকা থেকে ৫০ লাখ টাকার স্থায়ী আমানতপত্র করা হয়। এই আমানত থেকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ২০ সন্তানকে শিক্ষাবৃত্তি দিচ্ছে প্রথম আলো ট্রাস্ট।
শিক্ষাবৃত্তি পাওয়া বাগেরহাটের পাপিয়া আক্তার এখন সাভারের স্কলার্স ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ে। রানা প্লাজা ধসে তার মা পারভিন বেগমের মৃত্যু হয়। তখন পাপিয়া তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ত। তখন থেকে পাপিয়ার পড়ালেখার দায়িত্ব নেয় মেরিল–প্রথম আলো সাভার সহায়তা তহবিল। পাপিয়ার বাবা রিকশাচালক জাহিদ কাজী প্রথম আলোকে বলেন, মেয়েকে মানুষের মতো মানুষ করাই এখন তাঁর লক্ষ্য।

সাভার সহায়তা তহবিলের আওতায় বৃত্তি নিয়ে এখন যশোরের মিসকাতুল মারিয়া চতুর্থ শ্রেণি, সাভারের তানজির আহমেদ ষষ্ঠ, মানিকগঞ্জের মৃদুল হোসেন অষ্টম, রংপুরের মেহেদী হাসান নবম, যশোরের জান্নাতুল ফেরদৌস, মানিকগঞ্জের মাহবুবা রহমান, ময়মনসিংহের কামরুজ্জামান ও গোপালগঞ্জের খাদিজা আক্তার দশম এবং বরিশালের তানজিলা আক্তার, দিনাজপুরের মনিকা আক্তার ও পাবনার শারমিন আক্তার দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ছে। আর ফিন্যান্সে স্নাতক করছেন খুলনার রেদোয়ান হোসেন। এদের বাইরে সুমনা হক এসএসসির পর আর পড়ালেখা করেননি। রাঈমা জাহান স্নাতক করেছেন শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে। হাসান ইমাম ডিপ্লোমা করেছেন। এই তিনজনের স্থলে দুর্গত পরিবারের নতুন তিনজন শিক্ষার্থীকে শিক্ষাবৃত্তির আওতায় আনা হবে।

প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়কারী মাহবুবা সুলতানা বলেন, এ শিক্ষাবৃত্তির উদ্দেশ্যই হলো রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় নিহত ও আহত শ্রমিকদের সন্তানদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করা। শিক্ষার্থীদের স্নাতকোত্তর পর্যায় পর্যন্ত পড়াশোনায় এ সহায়তা দেওয়া হবে।