
ছেলেটা ক্লাস এইটে পড়ে। আমি তার সঙ্গে গল্পগুজব করি। একধরনের সখ্য তৈরি হয়। তাকে আমি বলি, ‘তুমি ড্রাগস নিয়েছ কখনো?’
ইংরেজি মাধ্যমে পড়া চমৎকার ছেলেটার মুখে এখনো শৈশবের আভা, বলে, ‘একবার-দুবার। বেশি নিই না।’
‘কী নিয়েছ?’
গাঁজা নিয়েছে সে। কী উপায়ে নিয়েছে, তা সে আমাকে বর্ণনা করে। আমি ব্যাপারটা ঠিক ধরতে পারি না। গাঁজা পুড়িয়ে পানীয়র সঙ্গে মিশিয়ে কীভাবে খায়, আমার ঠিক জানা নেই।
সে বলে, ‘আমাদের ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে তিন ভাগের এক ভাগ নিয়মিত নেশা করে। তিন ভাগের এক ভাগ মাঝে-মধ্যে নেয়। আর তিন ভাগের এক ভাগ আনস্মার্ট, ওরা কখনো নেয় না। ভালো ছাত্র। আমরা ওদের পাত্তা দিই না।’
‘তুমি ওই ভালোর দলে থাকলা না কেন?’
‘আমি কীভাবে থাকব। আমি তো অলরেডি স্পয়েল্ড।’
শুনে একটা বরফের সাপ আমার মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে যায়। ক্লাস এইটে পড়ে, কত আর বয়স এদের, ১৩ থেকে ১৫-১৬, এদের ক্লাসের দুই-তৃতীয়াংশ ড্রাগস নিয়েছে? এক-তৃতীয়াংশ নিয়মিতভাবে নেয়?
আমাদের এক অভিনেত্রীকে নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে অনলাইনে। কয়েক বছর আগেও তিনি ছিলেন পর্দার ব্যস্ত তারকা, এখন তিনি লোকচক্ষুর আড়ালে। সম্প্রতি নিজের একটা ছবি প্রকাশ করেছেন সামাজিক মাধ্যমে, সেই ছবির দিকে তাকানো যায় না। কী চেহারা হয়েছে তাঁর? তিনি লিখেছেন, তিনি ফিরে আসতে চান। কিন্তু পারছেন না।
কত জীবন নষ্ট হয়ে গেল। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়ি, সেই আশির দশকে, আমি যে হলে থাকতাম, সেটা ছিল নেশার আখড়া। গাঁজা থেকে শুরু করে হেরোইন, কী না আসত হলে। কী করে যে নেশারুদের দলের বাইরে থাকতে পেরেছিলাম, এখন নিজেকে ভাগ্যবানই মনে হয়। আমরা অবশ্য মফস্বল থেকে আসা ছেলের দল, আমরা দল বেঁধে গান গাইতাম, টেবিল টেনিস থেকে ফুটবল মাঠ দাবড়ে বেড়াতাম, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ব্যাপৃত থাকতাম, পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা থাকত, কেউ কেউ টিউশনি করত, আর বেশির ভাগই স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে কোনো না কোনোভাবে জড়িত ছিল। টেলিভিশন কক্ষে এইসব দিনরাত্রি প্রচারের সময় তিলধারণের জায়গা হতো না। তেমনি মোহামেডান-আবাহনী, ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা নিয়েও আমাদের হইহল্লা, মাতামাতি ছিল পাগলপারা। আমরা আসলে ড্রাগসের দলে ঢুকে পড়ার অবকাশটাই পাইনি। শহীদ স্মৃতি হলের তিনতলার বারান্দা থেকে দেখতাম, একটা সুন্দর সাদা গাড়ি এসে থামছে নিচের লনে, রাজহাঁসের মতো। সেখান থেকে বেরোত একজন বুয়েট ছাত্র, লম্বা, ফরসা, দেখতে যেন দেবদূত, তার পরনে হালকা নীল রঙের জিনস, গায়ে সাদা সুতির শার্ট, হাতা গোটানো। ভালো লাগত, খানিকটা ঈর্ষাও হতো। ভিখিরির মতো চৌধুরীদের গেটে দাঁড়িয়ে ভেতরের রাস উৎসব দেখার ঈর্ষা।
ওই ছেলে, একবার এক দীর্ঘ ছুটির সময়, হলের রুমে মরে পড়ে রইল। কয়েক দিন পরে তার লাশ উদ্ধার করা হলো। হাঁ করা মুখে মাছি ভনভন করছে। ছেলেটা নেশা করত।
আমি সেই ছেলেটাকে ভুলতে পারি না।
কয়েক বছর আগের ঘটনা। ঢাকার মোহাম্মদপুরে ঘটল একটা ঘটনা। ক্লাস ফাইভ-সিক্সে পড়ে এক ছেলে। রোজ স্কুলে যায়। স্কুলে যাওয়ার পথে সে পড়ে গেল কুসঙ্গে। নেশা ধরল। বাবা-মা জানেন না। যখন তাঁরা জানলেন, তাঁরা খেপে গেলেন। ছেলেকে আটকে রাখলেন ঘরে। নেশার যন্ত্রণায় ছটফট করা ওই শিশু জানালার কাচ ভাঙল, আর তা ঢুকিয়ে দিল নিজের পেটে। মা বলছেন, আমি নিজের চোখে দেখলাম ছেলে আমার রক্তাক্ত, আমি দৌড়ে গেলাম তাকে উদ্ধার করতে, ভেতর থেকে দরজা আটকানো, আমি কিছুই করতে পারছি না, আমার চোখের সামনে ছেলে মারা গেল। এই বর্ণনা প্রকাশিত হয়েছিল খবরের কাগজে। ধানমন্ডিতে কয়েক বছর আগে ঘটেছিল আরেকটা ঘটনা। এক মা গুন্ডা ভাড়া করেছিলেন তাঁর নিজের সন্তানকে হত্যা করার জন্য। নেশাসক্ত ছেলে মায়ের ওপরে, পরিবারের অন্যদের ওপরে রোজ এতটাই অত্যাচার করত।
এখন সারা বাংলাদেশ নেশার ছোবলে নীল হয়ে যাচ্ছে। কারও কারও মতে, বাংলাদেশে নেশাসক্তের সংখ্যা ৬০ লাখ। তার মানে, প্রতি দুই-তিনটা পরিবারের একটা নেশাসক্ত সদস্য নিয়ে তছনছ হয়ে আছে। হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে এই নেশাসামগ্রী বিদেশ থেকে আনার জন্য। সেটা দিয়ে প্রতিবছর কয়েকটা পদ্মা সেতু বানানো যেত।
বলা হচ্ছে, ইয়াবা আসে থাইল্যান্ড থেকে, মিয়ানমার হয়ে। এই বাণিজ্যের সঙ্গে অতিক্ষমতাবান থেকে শুরু করে নিম্নশ্রেণীর মানুষ জড়িত। সহজপ্রাপ্যতা নেশা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ার মূল কারণ।
সেদিন আমার বন্ধু চিত্রপরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকী টেলিফোনে আকুতি জানাচ্ছিলেন, আপনারা করছেনটা কী। আপনি জানেন, আজ থেকে দশ-বিশ বছর পরে এই ছেলেমেয়েগুলোর কী দশা হবে? তখন পুরো দেশটার কী হবে?
ইয়াবা ক্ষতি করে মস্তিষ্কের। প্রথম প্রথম না ঘুমিয়ে, অক্লান্ত চেহারা নিয়ে থাকার জন্য ব্যবহূত হয়। দিনে দিনে এর ওপরে নির্ভরতা বাড়ে, তখন ডোজ লাগে বেশি। মেজাজ খিটখিটে হবে, স্মৃতি দুর্বল হবে, যৌন ক্ষমতা চলে যাবে, খিদে থাকবে না, শেষতক মস্তিষ্ক কর্মক্ষমতা হারাবে। অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়বে আসক্ত ব্যক্তি। হূৎপিণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হবে, কিডনি ও ফুসফুস নষ্ট হবে। শেষ পরিণতি হবে মৃত্যু। তার আগে নেশাসক্ত ব্যক্তিটি হয়ে পড়বে এক বোঝা। সে নিজে কিছু করতে পারবে না, আশপাশের লোকদের জীবনকেও দুর্বিষহ করে তুলবে।
আপনার সন্তানকে স্কুলে দিচ্ছেন, কলেজে দিচ্ছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে দিচ্ছেন, সে সেখানে কী করছে আপনি জানেন না। সন্ধ্যায় যাচ্ছে রেস্তোরাঁয়, পেছনের স্মোকিং জোনে ঢুকে কী করছে আপনি জানেন? ঢাকার সিসা লাউঞ্জগুলোয় নিষ্পাপ চেহারার আড়ালে কী হয়, আমরা খোঁজ রাখি? সামাজিক-পারিবারিক মূল্যবোধ বলে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকছে না। এবং তারই সূত্র ধরে বাড়ছে অপরাধ। কাগজে লিখেছে, পুলিশকর্তা বলছেন, এখন যত অপরাধী ধরা হচ্ছে, এদের প্রায় সবাই নেশাসক্ত। নেশার কারবারিরা অপরাধ করছে, নেশার টাকা জোগাড় করার জন্য চুরিচামারি, ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। এখন অবস্থা এই যে মা খুন করাচ্ছেন সন্তানকে, সন্তান খুন করছে বাবা-মাকে। অথচ সমাজে কোনো বিকার নেই। রাষ্ট্র পরিচালকেরা টুঁ শব্দটি করছেন না। পাচারের সঙ্গে নাম আসছে হোমরাচোমরাদের।
সবচেয়ে ভালো তো নিজেকে নিরত রাখা। ‘নিজের দুটি চরণ ঢাকো তবে, ধরণী আর ঢাকিতে নাহি হবে।’ কিন্তু একটা অল্প বয়সী ছেলে বা মেয়ে এই ড্রাগস-সমুদ্রে নিজেকে বাঁচাবে কীভাবে। তার বন্ধুবান্ধব নিচ্ছে, সে বন্ধুদের দলে গিয়ে কী করে বন্ধুদের চাপ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখবে?
আর নেশা শুধু বড়লোকদের ছেলেমেয়েদের সমস্যা নয়। সব বয়সের, সব শ্রেণীর নারী-পুরুষ নেশার দ্বারস্থ হচ্ছে। নেশার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে দেহ বিক্রি করছে। নেশাসক্ত বাবার অত্যাচারে সন্তানেরা কেঁদেকেটে অস্থির। রাস্তার শিশুরা পর্যন্ত নানা ধরনের জিনিসপাতি নিয়ে নেশা করছে।
বিশ বছর পরের বাংলাদেশের দিকে কে তাকাবে?
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।