শিলা বেগমের বিয়ে হয়েছিল ১২ বছর বয়সে। এর চার বছরের মাথায় ২০০৬ সালে দুর্বৃত্তদের হাতে প্রাণ হারান তাঁর স্বামী খলিলুর রহমান। তার আগে এই দম্পতির কোলজুড়ে আসে তানজিলা আক্তার (নিপা) নামে ফুটফুটে এক সন্তান। স্বামীর মৃত্যুতে দিশাহারা হয়ে পড়েন শিলা। উপায় না পেয়ে ২০১০ সালে মেয়েকে বড় বোনের কাছে রেখে সাভারে পোশাক কারখানায় কাজ শুরু করেন তিনি। এখান থেকেই শুরু হয় শিলা ও তানজিলার জীবনসংগ্রাম।
সাভারের রানা প্লাজার ষষ্ঠ তলায় ইথারটেক্স লিমিটেড নামের একটি পোশাক কারখানায় জ্যেষ্ঠ অপারেটর হিসেবে কাজ শুরু করেন শিলা। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকাল পৌনে ৯টায় শিলা দেখেন, একটা বিশাল ঝাঁকির পর চোখের সামনে ছয়তলার মেঝে দুই ভাগ হয়ে সরে যাচ্ছে। কী করবেন বুঝে ওঠার আগেই ছাদ ধসে পড়ে। বসার টুল ভেঙে পড়ে গেলে কোমর আটকে যায়। এরপর আর মনে নেই। জ্ঞান ফেরার পর দেখেন, চারপাশ অন্ধকার। নড়াচড়া করতেই টের পেলেন ডান হাতের ওপর ছাদের ভাঙা অংশ পড়ে আছে। রাত প্রায় দেড়টার দিকে উদ্ধারকর্মীরা তাঁকে একটি সুড়ঙ্গ দিয়ে বের করার চেষ্টা করলে হঠাৎ একটি পিলারে আটকে যান তিনি। পিলারটি একটু সরাতেই তা শিলার পেটের ওপর পড়ে। আবার জ্ঞান হারান তিনি। মৃত ভেবে তাঁকে রেখেই বাকিদের উদ্ধারকাজ চালাতে থাকেন উদ্ধারকারীরা। একসময় জ্ঞান ফিরে এলে উদ্ধারকারীদের পিঠে হাত রেখে জানান দেন, তিনি এখনো বেঁচে আছেন। দুর্ঘটনার ১৮ ঘণ্টা পর বের করে আনা হয় তাঁকে। পরে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। তাঁর ডান হাত এখনো অচল।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসে ১ হাজার ১৩৫ পোশাককর্মী নিহত হন। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া শিলা কোনো ভারী কাজ আর করতে পারেন না। সংগ্রাম করে বেঁচে ফিরলেও মেয়েসহ এই আহত জীবন টেনে নিয়ে যাওয়ার মতো কোনো উপায় ছিল না শিলার। তাঁর মতো গুরুতর আহত হয়ে যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের পাশে তখন থেকেই দাঁড়িয়েছে প্রথম আলো।
সে সময় গঠন করা হয় মেরিল-প্রথম আলো সাভার সহায়তা তহবিল। ওই তহবিলে বিভিন্ন সময়ে জমা হয় প্রায় ২ কোটি ২৪ লাখ টাকা। এ থেকে প্রায় ৭১ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয় হয় উদ্ধারকাজ ও চিকিৎসায়। ১ কোটি ৫০ হাজার টাকা খরচ হয় ক্ষতিগ্রস্ত ১০১ জন মানুষের পুনর্বাসন সহায়তায়। ৫০ লাখ টাকার স্থায়ী আমানতপত্র করা হয়। এই আমানত থেকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ২০ সন্তানকে শিক্ষাবৃত্তি দিচ্ছে প্রথম আলো ট্রাস্ট। ২০১৪ সালের এপ্রিল থেকে এই শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া শুরু হয়। গত ৯ বছরে প্রথম আলো ট্রাস্টের এই সহায়তা নিয়ে অনেকেই পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন। শিলা বেগমের মেয়ে তানজিলাও এই শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে ২০২১ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছেন।
এ ছাড়া প্রথম আলো ট্রাস্টের এই শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে নিহত ইউসুফ রানার ছেলে রেদোয়ান হোসেন পড়ছেন স্নাতক তৃতীয় বর্ষে, নিহত রাশেদুল ইসলামের মেয়ে খাদিজা আক্তার মিলি এসএসসি পাস করেছেন। ময়না বেগমের মেয়ে মাহিয়া ২০২২ সালে এইচএসসি পরীক্ষা দেবেন। এসএসসি পাস করে ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি হয়েছেন নিহত কামাল হোসেনের ছেলে কামরুজ্জামান রোহান। রানা প্লাজার একটি পোশাক কারখানার কোয়ালিটি পরিদর্শক আল আমিন এখন অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে সরকারি চাকরি করছেন। আল আমিন তখন চাকরির পাশাপাশি স্নাতকে পড়তেন। দুর্ঘটনার পর তাঁর লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। ইতিমধ্যে শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন নিহত ইসমাইল বিশ্বাসের মেয়ে রায়মা জাহান, ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেছেন ছেলে ইমাম হাসান।
শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে নিহত ফোরকান হাওলাদারের দুই সন্তান হাসান মাহমুদ এইচএসসি পাস করেছেন ও ফারজানা আক্তার ষষ্ঠ শ্রেণিতে, নিহত পারভিন বেগমের মেয়ে পাপিয়া আক্তার এইচএসসি পরিক্ষার্থী, মমিনুল ইসলামের মেয়ে মনিকা আক্তার এইচএসসি প্রথম বর্ষ, আতাউর রহমানের ছেলে মৃদুল হোসেন নবম শ্রেণিতে, খুশি খাতুনের মেয়ে শারমিন আক্তার এইচএসসি পরীক্ষার্থী ও ছেলে নয়ন দশম শ্রেণিতে, রিফাত হাসানের মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস দশম শ্রেণিতে, মনোয়ারা বেগমের মেয়ে মাহবুবা পুষ্প দশম শ্রেণিতে, রেজাউল করিমের ছেলে মেহেদী দশম শ্রেণিতে পড়ছেন।
সম্প্রতি পড়াশোনা শেষ করেছেন এমন তিনজনের জায়গায় আগামী মে মাসে স্থলাভিষিক্ত হবেন আরও তিনজন। স্নাতকোত্তর পর্যায় পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে এই শিক্ষাবৃত্তি।