২০ দিনের অপেক্ষা ফুরাল

প্রথম আলো ট্রাস্টের উদ্যোগে নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলা সদরের বাহাদুরকান্দা ও বাসাউড়া গ্রামের অর্ধশতাধিক পরিবারকে খাদ্যসামগ্রী দেওয়া হয়। গতকাল বিকেলে বাসাউড়া গ্রামেছবি: সামছুর রহমান

নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার বাসাউড়া গ্রামের বাসিন্দা অর্চনা সাহা। তাঁর স্বামী সুধাংশু সাহা মারা গেছেন বেশ কয়েক বছর আগে। একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। অর্চনার সহায়-সম্বল বলতে ছিল এলাকার কয়েকজনের দানের টাকায় তোলা একটা টিনের ঘর। এবারের বন্যায় সেই ঘরও ধসে গেছে।

অসহায় অর্চনা আশ্রয় নিয়েছেন প্রতিবেশীর বাড়িতে। গত ১৬ জুন রাত থেকে নেত্রকোনা জেলায় আকস্মিক বন্যা শুরু হয়। এরপর ২০ দিন পেরোলেও গতকাল সোমবারের আগে কোনো ত্রাণসাহায্য পাননি অর্চনা। প্রথম আলো ট্রাস্টের দেওয়া খাদ্যসামগ্রী পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি।

গতকাল প্রথম আলো ট্রাস্টের উদ্যোগে নেত্রকোনায় বন্যায় বিপাকে পড়া কলমাকান্দা উপজেলা সদরের বাহাদুরকান্দা ও বাসাউড়া গ্রামের অর্ধশতাধিক পরিবারকে খাদ্যসামগ্রী দেওয়া হয়েছে। খাদ্যসামগ্রীর মধ্যে ছিল পাঁচ কেজি চাল, এক কেজি ডাল, এক লিটার সয়াবিন তেল, এক কেজি আটা, এক কেজি লবণ, এক কেজি চিনি, এক কেজি আলু, আধা কেজি পেঁয়াজ এবং ১০০ গ্রাম করে মরিচ ও হলুদের গুঁড়ার প্যাকেট।

দাদির সঙ্গে খাদ্যসামগ্রী নিতে এসেছিল মাদ্রাসাপড়ুয়া মো. কাউসার। সাত বছর বয়সী কাউসার খাদ্যের বস্তা কাঁধে তুলে নিয়ে দাদির পেছন পেছন হাঁটছিল। কাউসার বলল, ‘বাড়িতে এখনো পানি। খাওয়ার কষ্ট ছিল।’ কাউসারের দাদি মাজেদা বেগম বলেন, আগামী কয়েক দিন লোকজনের কাছে হাত পাতা লাগবে না।

গত কয়েক দিনে নেত্রকোনার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও এখনো তলিয়ে আছে বিভিন্ন এলাকার ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট। গতকাল কলমাকান্দা উপজেলা ঘুরে দেখা যায়, নিচু এলাকায় বাড়িঘর ও রাস্তাঘাটে এখনো বন্যার পানি আছে।

বাসাউড়া এলাকার প্রবীণ নারী কুসুম লতা সরকার। খাদ্যসামগ্রী পেয়ে কুসুম বললেন, ‘আমারে দেহার মতো কেউ নাই। একটা মাইয়া আছে, তার জামাইও মইরা গেছে। আমার বাড়িঘর কিছুই নাই। একজনের বাড়িত থাহি, পথেঘাটে মাইগ্গা খাই। বন্যার লাইগ্গা কোনোখানে যাইতে পারি না। বয়সও অনেক, চোখে দেহি না, চলতে পারি না। আমি একলা মানুষ, এই খাওন মেলা দিন যাইব।’

নেত্রকোনা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, কলমাকান্দা উপজেলার ৮টি ইউনিয়নে এখনো ৮০০ পরিবার পানিবন্দী। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উপজেলার সাড়ে ৫৮ হাজার মানুষ। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গতকাল পর্যন্ত ৯৬ মেট্রিক টন চাল, সাড়ে ১১ লাখ নগদ টাকা এবং ১ হাজার ২০০ প্যাকেট শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে, যা চাহিদার তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল।

পূর্ববাজার এলাকার লক্ষ্মী রানীর জন্ম থেকেই একটি হাত বাঁকা। ৬২ বছরের এই প্রতিবন্ধী নারী বলেন, ‘বন্যার পর থাইক্কা এই প্রথম আমারে কেউ কিছু দিছে। মাইনষে কয় সরকার অনেক কিছু দিতাছে, কিন্তু আমারে কেউ কিছু দেয় না। আমি বিধবা মানুষ। মাইনষের বাড়িতে কাম করি। এই খাওনের জিনিস আমার ১০–১২ দিন যাইব।’

ত্রাণ বিতরণে কলমাকান্দা সরকারি ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক রাজন কুমার সাহা, সমাজকর্মী বিভাস সাহা, প্রথম আলো বন্ধুসভার জেলা কমিটির সভাপতি শিশির হোসাইন, সাধারণ সম্পাদক শামীম আহম্মেদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

পাশে যাঁরা: আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেড ৯ লাখ ৭৫ হাজার টাকাসহ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, বিকাশ ও ব্যাংকের মাধ্যমে প্রথম আলো ট্রাস্ট ৩ জুলাই পর্যন্ত ৩০ লাখ ১৪ হাজার ৮৪০ টাকা অনুদান গ্রহণ করেছে। ইতিমধ্যে সিলেটের ৭টি উপজেলা, সুনামগঞ্জের ৩টি উপজেলা, নেত্রকোনার ৩টি উপজেলা এবং কুড়িগ্রামে ২৩ লাখ ৭৫ হাজার ৫০০ টাকার নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে।