বেদে-হিজড়াদের মুখে হাসি

সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার বন্যাদুর্গত মানুষের মধ্যে প্রথম আলো ট্রাস্টের উদ্যোগে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হয়। গতকাল দুপুরে জগন্নাথপুর শহীদ মিনার প্রাঙ্গণেছবি: আনিস মাহমুদ

শুধু ঘর নয়, পেশাও হুমকির মুখে পড়েছে বন্যায়। দোকান ভেসে যাওয়ায় জুতার কাজ করতে পারছে না মুচি সম্প্রদায়। নৌকা হারিয়ে তাঁবুতে থাকা বেদেরাও এখন অসহায়। হিজড়া বলে ত্রাণের তালিকায়ও গুরুত্ব পায় না তারা। আর বিয়ের আসরে আগের মতো ঢোল বাজানোর দাওয়াত পায় না শব্দকরেরা। বিপন্ন পেশার এসব মানুষ গতকাল মঙ্গলবার ঘরে ফিরল হাসিমুখে।

সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার ১০টি গ্রামের বিপন্ন পরিবারের মধ্যে গতকাল ত্রাণ বিতরণ করেছে প্রথম আলো ট্রাস্ট। সমাজে অবহেলিত বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ ত্রাণ পেয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। তাঁদের হাতে ত্রাণ তুলে দিয়েছেন বন্ধুসভার সদস্যরা।

হিজড়া সম্প্রদায়ের ৩৮ বছর বয়সী আবদুল জব্বার প্রথম আলোকে বলেন, হবিবনগর এলাকায় ১৫ জন হিজড়া পাশাপাশি থাকেন। বন্যায় তাঁদের ভিটা ভেসে গেছে। ১৬ দিন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমপ্লেক্সে আশ্রয় নিয়েছিলেন। শুকনা চিড়া, মুড়ি, বিস্কুট ছিল সম্বল। রান্নার সব পণ্য একসঙ্গে পেয়ে তাঁরা খুশি। তিনি বলেন, হিজড়া বলে কেউ পাত্তা দেয় না। ত্রাণ এলেও কেউ খবর দেয় না, তালিকায়ও নাম নেয় না।

জগন্নাথপুর বন্ধুসভার সদস্যরা গ্রামে ঘুরে ঘুরে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্য থেকে বেশি বিপন্ন মানুষের তালিকা করেছেন। তারপর তাঁদের হাতে একটি করে টোকেন দিয়েছেন। সেই টোকেন ধরে গতকাল ১২০টি পরিবারের কাছে চাল, ডাল, তেল, লবণ, হলুদ, মরিচ, আটা একসঙ্গে প্যাকেট করে তুলে দেওয়া হয়েছে।

জগন্নাথপুরের কলকলিয়া ইউনিয়নের কৃষক ৫৫ বছর বয়সী আদরিস মিয়া ৫ কিলোমিটার দূর থেকে এসেছেন ত্রাণ নিতে। তিনি বলেন, খেতের ধান ভেসে গেছে। ঘরও ডুবেছে বন্যায়। ত্রাণ ঘরে পৌঁছায় না। কেউ কেউ বারবার পায়, কেউ পায় না। টোকেন নিয়ে আসায় রান্না করার মতো সব জিনিস নিয়ে ফিরতে পেরেছেন।

বন্ধুসভার সদস্যরা জানান, মুচি সম্প্রদায়ের ১৫ পরিবার, হিজড়া জনগোষ্ঠীর ৫টি পরিবার, বেদে সম্প্রদায়ের ৬টি পরিবার, দলিত সম্প্রদায়ের পরিচ্ছন্নতাকর্মীর পাঁচ পরিবারসহ বিভিন্ন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পরিবার ত্রাণ পেয়েছে গতকাল। আরও একটি বিপন্ন পেশার মানুষও পেয়েছে সাহায্য। বিয়ের অনুষ্ঠানে ঢোল–বাদ্য বাজায় যারা, তারা শব্দকর নামে পরিচিত। এমন ১০টি পরিবারের হাতেও পৌঁছে গেছে প্রথম আলো ট্রাস্টের ত্রাণ। হবিবনগরের ৭০ বছর বয়সী ধীরেন কর প্রথম আলোকে বলেন, ‘এইতা পেশা অহন চলে কম। বিয়ার সিজনে কিছু কিছু চলে। বাকি সময় বিভিন্ন রহম কাজ করে ৪৫টি শব্দকর পরিবার।’ ১১ জনের পরিবার নিয়ে তিনি নিজে আছেন স্থানীয় সোনালী ব্যাংকের ওপরে একটি কোচিং সেন্টারের মধ্যে। ১৯ দিন ধরে ঘরে ফিরতে পারছেন না, ঘর ডুবে আছে। এক বেলা রান্না খাবার আর বাকি দুই বেলা চিড়া, মুড়ি, বিস্কুট খেয়ে কাটাচ্ছেন তাঁরা।

বন্ধুসভার হয়ে প্রথম আলো ট্রাস্টের ত্রাণ বিপদাপন্ন মানুষের হাতে তুলে দেন সহকারী পুলিশ সুপার (জগন্নাথপুর ও শান্তিগঞ্জ সার্কেল) শুভাশীষ ধর, বিটিভির সিলেট প্রতিনিধি মুক্তাদির আহমেদ, জগন্নাথপুর বন্ধুসভার উপদেষ্টা সাইফুল ইসলাম, শামীম আহমেদ, সুলেমান হোসেন, মইয়ুখ ভট্টাচার্য, শাহীনুর রহমান।

পাশে যাঁরা: আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেড ৯ লাখ ৭৫ হাজার টাকাসহ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, বিকাশ ও ব্যাংকের মাধ্যমে প্রথম আলো ট্রাস্ট ৪ জুলাই পর্যন্ত ৩০ লাখ ২৮ হাজার ৮৮৪ টাকা অনুদান গ্রহণ করেছে। ইতিমধ্যে সিলেটের সাতটি, সুনামগঞ্জের চারটি, নেত্রকোনার চারটি উপজেলা ও কুড়িগ্রামে বন্যার্তদের মধ্যে ২৩ লাখ ৭৫ হাজার ৫০০ টাকার নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে।

বন্যার্ত মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসতে পারেন আপনিও। সহায়তা পাঠানো যাবে ব্যাংক ও বিকাশের মাধ্যমে। ব্যাংক হিসাবের নাম: প্রথম আলো ট্রাস্ট/ত্রাণ তহবিল, হিসাব নম্বর: ২০৭২০০১১১৯৪, ঢাকা ব্যাংক লিমিটেড, কারওয়ান বাজার শাখা, ঢাকা। অথবা বিকাশে পেমেন্ট করতে পারেন: ০১৭১৩০৬৭৫৭৬ এই মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট নম্বরে। এ ছাড়া বিকাশ অ্যাপের ডোনেশনের মাধ্যমেও আপনার সহযোগিতা পাঠাতে পারেন।