‘দুই নাতিরে নিয়া পেঠ ভইরা ভাত খাইমু’

প্রথম আলো ট্রাস্টের উদ্যোগে দেওয়া ত্রাণসামগ্রী নিয়ে বাড়ি ফিরছেন বন্যার্ত মানুষেরা। গতকাল দুপুরে সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার দেখার হাওরপারের শরীয়তপুর গ্রামেছবি: খলিল রহমান

‘আমার জামাই নাই। পাগল (মানসিক প্রতিবন্ধী) পুয়া (ছেলে) এক বছর ধরি নিখোঁজ। দুই নাতি নিয়া থাকি। বন্যাত ঘর ধসি গেছে। ঘরের সবতা নষ্ট অইগিছে। খানি নাই, কেউ ইকানো আয় না। দিনে এক বেলা খাইলে, দুই বেলা উপাস থাকি। আজকু (আজ) তোমরার খানি পাইয়া বড় খুশি অইছি। দুইটা নাতিরে লাইয়া রাইত পেঠ ভইরা ভাত খাইমু।’

প্রথম আলো ট্রাস্টের দেওয়া খাদ্যসামগ্রী পেয়ে এভাবেই নিজের দুর্দশার পাশাপাশি খুশির কথা জানালেন জাহানারা বেগম (৫০)। তাঁর বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলার শান্তিগঞ্জ উপজেলার দেখার হাওরপারের মানিকপুর গ্রামে। প্রথম আলো বন্ধুসভার সদস্যরা গতকাল রোববার দুপুরে নৌকায় করে খাদ্যসামগ্রী নিয়ে যান তাঁর বাড়ি।

শুধু জাহানারা বেগম একা নন, গতকাল প্রথম আলো ট্রাস্টের উদ্যোগে সুনামগঞ্জে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় বিপাকে পড়া এই উপজেলার হাওরপারের দুর্গম রহমতপুর, রনসি, মানিকপুর, শরীয়তপুর, শাহজালালপুর ও কাদিপুর গ্রামের ১৫০টি বন্যার্ত পরিবারকে খাদ্যসামগ্রী দেওয়া হয়েছে প্রথম আলো ট্রাস্টের উদ্যোগে। খাদ্যসামগ্রীর মধ্যে ছিল পাঁচ কেজি চাল, এক কেজি ডাল, এক লিটার সয়াবিন তেল, এক কেজি আটা, এক কেজি লবণ, ১০০ গ্রাম করে দুটি মরিচ ও হলুদের গুঁড়ার প্যাকেট।

বন্ধুসভার সদস্যরা প্রথমে পিকআপে করে এই ত্রাণ নিয়ে যান শান্তিগঞ্জ উপজেলার মহাসিং নদের ডাবর ঘাটে। এরপর সেখান থেকে নৌকার করে এসব গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বন্যাদুর্গত অসহায় মানুষের হাতে খাদ্যসামগ্রী তুলে দেন।

মানিকপুর গ্রামের শ্রমিক আবদুল মালিকের (৪৫) বসতঘরটি হাওরের ঢেউয়ে একেবারে ভেঙেচুরে একাকার হয়ে আছে। স্ত্রী, দুই মেয়ে আর তিন ছেলে নিয়ে মানবেতর দিন যাপন করছেন তিনি। ঘরের চারদিকে পানি। তাই ঘরের চালে উঠে বসেছিল দুই মেয়ে সুলতানা বেগম ও ফাতেমা বেগম। ত্রাণের নৌকা দেখেই হাত তোলে তারা। এরপর বন্ধুসভার সদস্যরা নৌকা নিয়ে যান ওই বাড়িতে। মালিক মিয়ার স্ত্রী শামীমা বেগমের হাতে তুলে দেন খাদ্যসামগ্রী। খাবারের বস্তা পেয়ে শামীমা বেগম (৩৫) বলেন, ‘আমরার ইকানো কেউ আয় না। কেউ কুনতা দেয় না। বাইচ্চাইনতেরে লইয়া বড় বিপদও আছি। ভাত খাওয়ার লাগি খান্দে। আজকু যে খানি পাইলাম, তা দিয়া আমার এক সপ্তাহ যাইব।’

শাহজালালপুর গ্রামের ফজলুর রহমান (৫০) খাদ্যসামগ্রী পেয়ে জানান, দেখার হাওরপারের এই গ্রামগুলো দুর্গম এলাকায় হওয়ায় কেউ আসতে চায় না। নৌকা ছাড়া এসব গ্রামে আসা যায় না। কেউ আসতে চাইলে নৌকা ভাড়া করে আসতে হয়। গ্রামের মানুষজন খুবই দরিদ্র। হাওরপারের এই দুর্গম গ্রামগুলোতে একেবারে ঘরে ঘরে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেওয়ায় প্রথম আলো ট্রাস্টের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান তিনি।

গতকাল খাদ্যসামগ্রী বিতরণকালে সুনামগঞ্জ বন্ধুসভার উপদেষ্টা মোহাম্মদ রাজু আহমেদ, সাবেক সভাপতি রনজিত কুমার দে, সমাজকর্মী মোহাম্মদ আম্মার, বন্ধুসভার বর্তমান সভাপতি শাহজাহান আলম সিদ্দিকী, সহসভাপতি প্রদীপ পাল, সাধারণ সম্পাদক মো. শাহিদুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাজীব দেব, সদস্য জাকের আহমেদ, শাহাব উদ্দিন, শামস উদ্দিন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

প্রথম আলো ট্রাস্টের উদ্যোগে আজ সোমবার জেলার বিশ্বম্ভরপুর ও সদর উপজেলায় একইভাবে বন্যাদুর্গত মানুষদের মধ্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হবে