সরল শেখের সফলতার পথ সরল ছিল না

নাটোরের লালপুর উপজেলায় বাড়ি সরল শেখের বসতভিটা ছাড়া কোনো জমাজমি ছিল না সরল শেখদের। বাবা দিনমজুরি কাজ করে সংসার চালাতেন। মা গৃহিনী। অভাবের কারণে সরলের বড় ভাই তেমন পড়াশোনা করতে পারেনি। পরিবারের অবস্থা যখন এমন, সে ক্ষেত্রে সরল এগিয়ে গেছেন একমাত্র তাঁর অদম্য ইচ্ছার বলে। এসএসসি পর্যন্ত প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার আগে গবাদিপশুর জন্য তাঁকে ঘাস কাটতে হতো। গবাদিপশু পালন করে এবং বাবাকে দিনমজুরি কাজে সাহায্য করে পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন সরল। পরে প্রথম আলোর প্রতিনিধির মাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলে ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তির জন্য নির্বাচন করা হয়। তারপর এইচএসসি থেকে স্নাতক পর্যন্ত এই তহবিল থেকে শিক্ষাবৃত্তি পেয়ে পড়াশোনা করেন তিনি। ১ মার্চ ২০২১ হতে কর্মরত আছেন বরিশাল সিটি করপোরেশনে সহকারী প্রকৌশলী (সিভিল) হিসাবে।

অদম্য সরল শেখ সাহস নিয়ে প্রতিকূলতা অতিক্রম করেছেন এবং সফলও হয়েছেন। তাঁর সফলতার গল্প ওঠে আসে ৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ (শনিবার), বিকেল ৪টা ৩০মিনিটে প্রথম আলো ট্রাস্টের নিয়মিত আয়োজন ‘অদম্য মেধাবীর সঙ্গে’ অনলাইন অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানটি একযোগে প্রচার করা হয় প্রথম আলোর ইউটিউব চ্যানেল, প্রথম আলো এবং প্রথম আলো ট্রাস্টের ফেসবুক থেকে। সঞ্চালনায় ছিলেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা।

সরল শেখ প্রথমেই বলেন, ‘আমার পথচলাটা মসৃণ ছিল না। সকালে ওঠে গবাদিপশুর ঘাস কাটা, বাবা দিনমজুরি কাজে সাহায্য করে স্কুলে যেতে হতো। নবম শ্রেণিতে সায়েন্স নিতে পারব কিনা তা নিয়ে সংশয় ছিল। কারণ অভাব-অনটনের সংসারে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়াই কঠিন ছিল। আমার শিক্ষক অরূপ কুমার সাহা আমাকে সারা বছর ফ্রিতে পড়াইছেন। তাঁর কাছে আমি কৃতজ্ঞ। কঠোর পরিশ্রম করে ২০০৮ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাই। কিন্তু এই ভালো ফল করেও মনে দুশ্চিন্তা বাসা বেঁধেছে। তখন প্রথম আলোর লালপুর প্রতিনিধি আমাকে নিয়ে প্রতিবেদন করেন এ রকম ‘দিনমজুর বাবার ছেলে পেল জিপিএ-৫’। পরে ‘ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তি’ পাই। এই বৃত্তি আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। আমি নতুন করে স্বপ্ন দেখতে সাহস করি। এভাবে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়েও জিপিএ-৫ অর্জন করি। আমাকে পুনরায় উচ্চশিক্ষার জন্যও শিক্ষাবৃত্তি দেয় ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট। এই শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে আমি রাজশাহী বিজ্ঞানও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংবিভাগে পড়াশোনা শেষ করেছি। এ জন্য আমি প্রথম আলো ট্রাস্ট ও ব্র্যাক ব্যাংকের কাছে কৃতজ্ঞ।’

তিনি আরও বলেন, ‘বৃত্তির জন্য নির্বাচন করার পর আমাদের ঢাকায় এনে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। আমি আমার মাকে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেই অনুষ্ঠানে অনেক অনুপ্রেরণামূলক কথা শুনেছিলাম, যা আমার আগ্রহকে আরও বাড়িয়ে দেয়। শুধু অর্থনৈতিকভাবে নয়, কীভাবে ভালো মানুষ হব সেই দিকনির্দেশনাও পেয়েছি। বিশেষ করে কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক স্যারের কথাগুলো মনে পড়ে। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে অনুপ্রেরণামূলক কথাগুলো আমাকে আরও অধ্যবসায়ী ও সাহসী হওয়ার প্রেরণা দিয়েছে। যেমন, স্নাতক পর্যায়ে ভর্তির জন্য ৭টা ফরম ওঠাই। আমার ৪টাতেই চান্স পেয়েছিলাম। এখন আমি আজকের জায়গায় আছি। এই পুরো জার্নিতে প্রথম আলো ট্রাস্ট ও ব্র্যাক ব্যাক আমার পাশে ছিল।

পড়াশোনা শেষে চাকরি পাওয়ার বিষয়ে জানাতে চাইলে সরল জানান, আমার বন্ধুরা ৩৭তম বিসিএসে ক্যাডার হলো। আমিও চেষ্টা করতেছিলাম। এদিকে সংসারে অভাব। তাই বেসরকারি চাকরিতে যোগ দেই। এর মধ্যে ২ বার বিসিএসে লিখিত পরীক্ষা দেই, কিন্তু হয়নি। পরে চাকরি ছেড়ে আবার চাকরির পড়াশোনা শুরু করি। তারপর প্রথম শ্রেণির এই চাকরি জয়েন করি।’

আর কি স্বপ্ন দেখেন সরল, জানাতে চাইলে জানান, মা-বাবার সেবা করতে চাই। পাশাপাশি নিজের কাজের জায়গায় আরও ভালো করতে চাই। একই সঙ্গে প্রথম আলোর সঙ্গে, তাদের পথচলার সঙ্গে থাকতে চাই। আমাদের মতো অদম্যদের জন্য প্রথম আলোর এই প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকুক।’

মা-বাবার অনুভূতি কেমন জানতে চাইলে সরল জানান, ‘৮ম শ্রেণি পর্যন্ত বাবার দিনমজুরি কাজে আমি সাহায্য করেছি। তাঁরা দুজনেই খুব খুশি। বিশেষ করে আমার মা। তিনি অনেক কষ্ট করেছেন।’

প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যেতে গিয়ে অনেকেই সাহস হারিয়ে ফেলেন। তাঁদের উদ্দেশে সরল শেখ বলেন, ‘করোনা মহামারিতে সারা বিশ্ব বিপর্যস্ত। এই পরিস্থিতিতে নতুনদের বলব, শান্ত থাকতে হবে, পরিবারকে বেশি সময় দিতে হবে। মনোবল হারানো যাবে না। মন ভালো রাখতে নানা রকম সামাজিক কার্যক্রম করতে পরামর্শও দেন তিনি। পরিশেষে প্রথম আলোর প্ল্যাটফর্মে এ ধরনের একটা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য ধন্যবাদ জানান।’