সুরাইয়ার হুদার বয়স তখন ৫ বছর। পোলিওতে আক্রান্ত হয়ে তাঁর ডান পা অচল হয়ে যায়। আজ থেকে ২০ বা ২২ বছর আগে তাঁর অসচ্ছল পরিবারের পক্ষেতাকে চিকিৎসা করানো সম্ভব হয়নি। অচল ডান পা নিয়ে সেই বছর আর স্কুলে ভর্তি হওয়া হয়নি তাঁর। পরের বছর ক্লাসে টুতে ভর্তি হলেন ঠিকই কিন্তু বাড়ি থেকে কয়েক কিলোমিটার দুরে স্কুল। কী আর করা! শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়েই হেঁটে স্কুলে যেতেন তিনি। কখনও কখনও বন্ধুদের কাঁধে ভর দিয়ে একটু সাহায্য নিতেন। প্রাথমিকের পালা শেষ করে আকিজ কলিজিয়েট স্কুলে ভর্তি হলেন। কিন্তু সেই এতটুকুন বয়সে যাঁর জীবনের যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, তাঁর জীবনে যেন পদে পদে পরীক্ষাই লিখে রেখেছিলেন বিধাতা।
সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় আকস্মিক স্ট্রোকে বাবাকে হারান সুরাইয়া। অস্বচ্ছল পরিবারে শুরু হয় অভাবের আনাগোনা। ফলাফল ভালো করতেন বলে শিক্ষকেরা তাঁকে বরাবরই খুব স্নেহ করতেন। সেই সময়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা স্কুলের বেতন মওকুফ করে দিয়ে পড়াশোনায় সহযোগিতা করেন। এই যে এতো কষ্ট করে পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন সুরাইয়া, তাঁর ফলও পেয়েছেন। ২০১২ সালে জিপিএ-৫ পেয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে এসএসসি পাস করেন। পরে অদম্য মেধাবীদের তালিকায় নাম আসে তাঁর। উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্টের অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তি পান। টাকা দিয়ে সুরাইয়া পড়াশোনার খরচ চালিয়েছেন আবার সংসারে সাহায্য করেছেন। পড়াশোনায় সাফল্যের ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছিলেন হার না মানা অদম্য মেয়েটি। এইচএসসিতেও জিপিএ-৫ পান।
এবার পালা উচ্চশিক্ষার পথে পা বাড়ানোর। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষা দিলেন। ভর্তি পরীক্ষায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবন্ধি কোটায় এবং কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধা তালিকায় সুযোগ পান তিনি। সুরাইয়া সিদ্ধান্ত নেন তাঁর নিজের মেধাকে বেছে নেওয়ার। তিনি সিদ্ধান্ত নেন মেধা দিয়ে যেখানে সুযোগ পেয়েছেন, তিনি সেখানেই ভর্তি হবেন। ভর্তি হন কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁর ধারাবাহিক সাফল্যের জন্য স্নাতক (সম্মান) পর্যায়েও ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী তহবিলের শিক্ষাবৃত্তি পান তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ২য়বর্ষে পড়ার সময় সহপাঠীদের সঙ্গে মিলে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেন। অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য যেই পরীক্ষায় তিনি বসেছিলেন, সেই পরীক্ষাতেও তিনি নির্বাচিত হয়ে ভাইভার সুযোগ পেয়ে যান।
সুরাইয়ার জীবনের সবচেয়ে বড় যুদ্ধটা বোধকরি তখন থেকেই শুরু হয়।তাঁকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, চাকরি করবেন নাকি পড়াশোনা চালিয়ে যাবেন। একদিকে সেই ছোটবেলা থেকে এত কষ্ট করে পড়াশোনা চালিয়ে নিয়ে আসার যুদ্ধের গল্প, আরেকদিকে সংসারের অভাবের বাস্তবতা। জীবনযুদ্ধের জুজুকে চ্যালেঞ্জ করে সুরাইয়া সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি চাকরিও করবেন। সঙ্গে পড়াশোনাও শেষ করবেন। তাঁর কর্মস্থল হয় যশোরের একটি স্কুলে। সেখানে তিনি সপ্তাহে ৬ দিন ক্লাস নিতেন। বৃহস্পতিবার ক্লাস শেষ করে যেতেন কুষ্টিয়ায় সহপাঠীদের কাছ থেকে সারা সপ্তাহের পড়াশোনা বুঝে নিতে। নিয়মিত ক্লাস করতে পারতেন না বলে হলের সিটটা কিছুদিনের মধ্যেই বাতিল হয়ে যায়। সহপাঠীদের কাছ থেকে নোট সংগ্রহ করে শুক্রবার সন্ধ্যায় আবার তিনি ফিরতেন যশোরে। সেই ২য়বর্ষের পর থেকে এইভাবেই লোকাল বাসে স্ক্র্যাচ হাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে তিনি যশোর থেকে কুষ্টিয়া যাতায়াত করেছেন। পরীক্ষার সময় সকাল বেলা যশোর থেকে কুষ্টিয়া গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে আবার তিনি যশোরে ফিরে আসতেন। এভাবেই সুরাইয়া বিবিএ আর এমবিএ শেষ করেন।
অদম্য মেধাবীদের জন্য আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে একবার সুরাইয়া বলেছিলেন তিনি ব্যাংকে কাজ করবেন। কিন্তু এখন তাঁর কাছে জানতে চাইলে এক গাল হেসে বললেন, 'আমি শিক্ষকতাই করব। প্রাথমিক পর্যায়ের ছেলেমেয়েরা আমার কোলে বসে ক্লাস করে, কেউ কেউ আমাকে 'মা' বলে ডাকে। আমার ছাত্রছাত্রীরা, সহকর্মীরা আমাকে এত ভালোবাসা দিয়েছে। আমি এখন এদের ছেড়ে কোথাও যেতে চাই না। আমি ওদেরকে আমার যুদ্ধের গল্পটা বলি। ওদের আমি বলার চেষ্টা করি যে, জীবনে কখনো থেমে গেলে হবে না। যাই হোক না কেন জীবনে এগিয়ে যেতে হবে। আমি এখন ওদের নিয়ে স্বপ্ন দেখি। হয়তো আমার মতো কেউ ওদের মধ্যে আছে। তাদের বিকাশের দায়িত্ব আমার। এটাই আমার স্বপ্ন।'
সুরাইয়া আরও বলেন, ' আমি যদি শারীরিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে চাকরি আর পড়াশোনা একসাথে চালিয়ে যেতে পারি, তাহলে এখন যারা অদম্য মেধাবী আছে তারাও পারবে। কখনো ভাবা যাবে না যে, আমি পারব না। চেষ্টা করা হলে পারা যাবে না পৃথিবীতে এমন কোনো কাজ নেই। ইচ্ছা শক্তি থাকলে সব সম্ভব। মানসিক শক্তি ধরে রাখতে পারলে কোন বাধাই বাধা না। তা ছাড়া আমাদের পাশে প্রথম আলো ট্রাস্ট তো আছেই। অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তি সম্পর্কে সুরাইয়া বলেন, 'যখন আমি অদম্য শিক্ষাবৃত্তি পেয়েছি, তখন আমার মনে হলো, আমি যেন আমার বাবাকে ফিরে পেয়েছি। বাবা যেমন দায়িত্ব নিয়ে সন্তানের পড়াশোনা করান, তখন আমি তেমন একটা আলোর পথ খুঁজে পেলাম। তখন থেকে আমি ট্রাস্টের শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা করেছি। জীবনযুদ্ধের সব পরীক্ষায় সফলতার সঙ্গে পাস করে সামনে এগিয়ে যাওয়া সুরাইয়া জানান, 'আমার একমাত্র লক্ষ্য আমার মাকে ভালো রাখা। আমি আমার সংসার সামলে মাকে সময় দেই। মাঝে যখন মায়ের করোনা হল তখন আমিই মাকে নিয়ে যশোরে ডাক্তার দেখানসহ সব কিছু করেছি। আমার খুব ভালো লাগে যখন আমি মায়ের জন্য কিছু করতে পারি। মূলত আমার জীবনের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য যত দিন আমি বেঁচে থাকব তত দিন মায়ের পাশে থাকার।'