‘ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আমার গল্প শোনাব, যাতে তারা মনোবল পায়’

ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী তহবিলের শিক্ষাবৃত্তি প্রাপ্ত মো. ইমান আলী।

জামালপুরে ইসলামপুর উপজেলার মুরাদাবাদ গ্রামের দরিদ্র পরিবারের ছেলে মো. ইমান আলী। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে ইমান আলী সবার ছোট। অভাব-অনটনের সংসারে বড় চার ভাইয়ের কারওই পড়াশোনা করা সম্ভব হয়নি। কেউ পোশাককারখানায় , কেউ রিকশা চালিয়ে যার যার সংসার চালান। বাবা দিনমজুরি করে সংসার চালান।

এদিকে, ছোটকালে রাখালের কাজ করতেন ইমান আলী। ছোট থেকেই পড়াশোনার ঝোঁক ছিল প্রচণ্ড। কিন্তু পারিবারিক অস্বচ্ছতার কারণে বাধা পেতে হয়েছে পদে পদে। কিন্তু কোন বাধাই তাকে আটকাতে পারেনি। অদম্য ইচ্ছা শক্তি নিয়ে এগিয়ে গেছেন। ২০১২ সালে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়ার পর প্রথমে আলোতে প্রতিবেদন ছাপা হয়। নির্বাচিত হন ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো অদম্য মেধাবী হিসেবে। ভর্তি হন তেজগাঁও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে অটোমোবাইল টেকনোলজি বিভাগে।

শিক্ষাবৃত্তি পেয়ে পড়াশোনা চালিয়ে ২০১৭ সালে ডিপ্লোমা পাস করে চাকরি শুরু করেন রানার অটোমোবাইলে। বর্তমানে চাকরি করছেনর যশোরের নড়াইল রোডস্থ উত্তরা মটরস লিমিটেডে সার্ভিস ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে। ইমান আলী চাকরি পেয়ে পুরো সংসারে দায়িত্ব নিয়েছেন। এখন আর বাবাকে দিনমজুরি করতে হয় না।

পরিবারে অভাব ছিল চরম, কিন্তু লক্ষ্যে অটল ছিলেন ইমান আলী। তার ফলও পেয়েছেন হাতে হাতে। তাঁর এই যে পথচলা, সেই গল্প ওঠে আসে ১৩ জুন ২০২২, সোমবার, বিকেল ৪টা ৩০মিনিটে প্রথম আলো ট্রাস্টের নিয়মিত আয়োজন ‘অদম্য মেধাবীর সঙ্গে’ অনলাইন অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানটি একযোগে প্রচার করা হয় প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ইউটিউব চ্যানেল এবং প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ফেসবুক পেজ থেকে। সঞ্চালনায় ছিলেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা।

ছোট বেলার গল্প বলতে গিয়ে ইমান আলী জানান, ‘প্রাথমিক পাস করা পর্যন্ত তেমন সমস্যা হয়নি। হাইস্কুলে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই সমস্যায় পড়ি। বাবা কৃষি কাজ করতেন। একদিন কাজ থাকলে আরেকদিন থাকত না। আমি নিজেও কাজ করেছি। আমি যখন ৮ম শ্রেণিতে উঠি তখন বাবা অসুস্থ হয়ে আর কাজ করতে পারেনি। তখন অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। অনেকে সাহায্য সহযোগিতা করেছে। এভাবে এসএসসি পাস করি জিপিএ-৫ পেয়ে। কিন্তু খুশি হতে পারিনি। কোথায় ভর্তি হব তা নিয়ে শঙ্কায় ছিলাম। আসলে নিম্নবৃত্ত পরিবারে অনেক সমস্যার মধ্যদিয়ে যেতে। আমাকেও হয়েছে। এমন সময় প্রথম আলোর প্রতিবেদক আমাদের বাড়িতে আসেন, আমাকে নিয়ে প্রতিবেদন করেন। প্রতিবেদন হওয়ার পর আমাকে শিক্ষাবৃত্তির আওতায় নিয়ে নেয়। তখন আমিসহ আমার পরিবার খুব খুশি হয়। আমি অনেকটা স্বস্তি ফিরে পাই। আসলে কাউকে না কাউকে পাশে দাঁড়াতে হয়। আমার পাশে দাঁড়িয়েছে প্রথম আলো ট্রাস্ট ও ব্র্যাক ব্যাংক। আমাদের মতো যারা আছে তাদের জন্য ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট খুব দরকার। এ জন্য তাদের জানাই অসংখ্য ধন্যবাদ।’

আমার ইচ্ছা, কর্মজীবনের পাশাপাশি আমাদের মতো যার অসহায় আছে তাদের পাশে দাঁড়াব। উচ্চশিক্ষা অর্জন করব।

এর পরের যাত্রা কেমন ছিল জানতে চাইলে ইমান আলী জানান, ‘এসএসসি সম্পন্ন করার পর ডিপ্লোমা পরীক্ষা দেই। ঢাকার তেজগাঁও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে অটোমোবাইল টেকনোলজি বিভাগে ভর্তির সুযোগ পাই। গ্রামের ছেলে শহরে গিয়ে কিছু বেগ পেতে হয়েছে। প্রথমে এক মামার বাসায় উঠি, উনি অনেক সাহায্য করেছেন। পরে হোস্টেলে ওঠি। পরে প্রথম আলোর সহযোগিতায় আমার ডিপ্লোমা শেষ করি। পরে রানার অটোস-এ জয়েন করে আড়াই বছর চাকরি করি। এখন উত্তরা মটর্‌স-এ চাকরি করছি প্রায় ২ বছর হলো। আমার পরিবারে কিছু সমস্যা আছে সেগুলো মেটাতে চেষ্টা করছি। এরপর বিএসসি করার ইচ্ছা আছে।’

মা-বাবার অনুভূতি কেমন জানতে চাইলে জানান, ‘তাঁরা অনেক খুশি এখন। আমি চাকরি করে পরিবার দেখাশোনা করছি। বাবাকে দিনমজুরি কাজ করতে হতো। এখন আর করতে হয়ে না। এটা আমার জন্যও ভালো লাগার একটা বিষয়।’

কি স্বপ্ন দেখেন ইমান আলী জানতে চাইলে জানান, ‘মানুষ মাত্রই স্বপ্ন দেখে, আমিও দেখি। আমার ইচ্ছা, কর্মজীবনের পাশাপাশি আমাদের মতো যার অসহায় আছে তাদের পাশে দাঁড়াব। উচ্চশিক্ষা অর্জন করব। যেহেতু পড়াশোনা ছাড়া জীবন উন্নত করার উপায় নেই। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আমার গল্প শোনাব, যাতে করে তারা মনোবল পায় এবং বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে পারে।’