‘বিনা মূল্যে অসহায়দের চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাব’

ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তি পাওয়া ডা. আবু হোসাইন। গত ১২ মে অনলাইন অনুষ্ঠানে।

যশোরের কেশবপুর উপজেলার বায়সা গ্রামের আবু হোসাইনের বাড়ি। বাবা আবু বক্করের মৃত্যুর পর তিন সন্তানকে নিয়ে মহা বিপদে পড়েন মা জয়নুর বেগম । জয়নুর বেগম পরের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করেন। তার বৃদ্ধ শ্বশুর (আবু হোসাইনের দাদা) পরের জমিতে কামলা খাটেন। এসএসসি পরীক্ষার আগে আবুকেও অন্যের জমিতে কামলা দিতে হতো। এত কিছুর পরও থেমে যাননি তিনি। কঠোর পরিশ্রম করে ২০০৯ সালে মাধ্যমিক ও ২০১১ সালে উচ্চমাধ্যমিকে জিপিএ-৫ পান। নির্বাচিত হন ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো অদম্য মেধাবী হিসেবে। শিক্ষাবৃত্তি পেয়ে পড়াশোনা চালান। পরে ২০১২-১৩ সেশনে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস পড়ার সুযোগ অর্জন করেন। প্রথম আলো ট্রাস্ট থেকে আবারও শিক্ষাবৃত্তির জন্য নির্বাচিত হন।

পরিবারে অভাব ছিল চরম, কিন্তু লক্ষ্যে অটল ছিলেন আবু হোসাইন। তার ফলও পেয়েছেন হাতে হাতে। এখন আবু হোসাইন কর্মরত সাতক্ষীরা ইসলামী ব্যাংক কমিউনিটি হাসপাতালে রেসিডেনসিয়াল মেডিকেল অফিসার হিসেবে। সম্প্রতি প্রকাশিত ৪২তম বিসিএসে নন- ক্যাডারে বাংলাদেশ পুলিশ হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার হিসেবেও সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। তাঁর এই যে পথচলা, সেই গল্প ওঠে আসে ১২ মে ২০২২, বৃহস্পতিবার, বিকেল ৪টা ৩০মিনিটে প্রথম আলো ট্রাস্টের নিয়মিত আয়োজন ‘অদম্য মেধাবীর সঙ্গে’ অনলাইন অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানটি একযোগে প্রচার করা হয় প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ইউটিউব চ্যানেল এবং প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ফেসবুক পেজ থেকে। সঞ্চালনায় ছিলেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা।

অনুষ্ঠানে আবু হোসাইন বলেন, ‘ আমি ৫ম বা ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় বাবা মারা যায়। পরে দাদার ওপর সব ভার পড়ে। ফলে দাদাকে অন্যের জমিতে কাজ করে সংসারের খরচ মেটাতে হয়েছে। আমাকেও যেতে হয়েছে দাদার সঙ্গে কাজ করতে। আমি ছাত্র হিসেবে ভালো হওয়ায় শিক্ষকেরা সব সময় সহযোগিতা করেছে। নবম শ্রেণিতে যখন উঠি তখন কোন বিভাগ নিব তা নিয়ে সংশয় ছিল। বিজ্ঞান বিভাগে খরচ বেশি। তখন আমার শিক্ষকগণ অভয় দেন। ওই বছর আমরা দুজন বিজ্ঞান নিয়েছিলাম। সকল শিক্ষক আমাকে ফ্রি পড়ান। আমারও একটা দায় ছিল। পরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাই। দুজনেই জিপিএ-৫ পেয়েছিলাম এবং আমরাই প্রথম এই স্কুল থেকে জিপিএ-৫ পাই।

যেকোনো প্রতিকূলতায় ভেঙে পড়া যাবে না। মনোবল শক্ত রাখতে হবে। আমরা তো প্রতিকূলতার মধ্যদিয়েই বড় হই। তাই যেকোনো বাধা মোকাবিলা করতে হবে। তখন সফলতা আসবেই।

দাদার অনুভূতি কেমন ছিল জানতে চাইলে জানান, ‘আসলে দাদা অনেক পরিশ্রমী ও ধার্মিক ছিলেন। আমার জন্য নামাজ পড়ে দোয়া করতেন। জিপিএ-৫ কি সেটা হয়তো দাদা বুঝতেন না। তবে ভালো ফল করেছি সেটা তিনি বুঝেন। আমি সব বিষয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছিলাম। তখন প্রথম আলো কেশবপুর প্রতিনিধি দিলীপ মোদক দাদা আমাকে নিয়ে একটা প্রতিবেদন করেন। প্রতিবেদন দেখে প্রথম আলো ট্রাস্ট থেকে শিক্ষাবৃত্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। দুই বছর সেখান থেকে শিক্ষাবৃত্তি পাই। কেশবপুর কলেজে ভর্তি হই। কলেজেও আমার কাছে কোন টিউশন ফি নেয়নি। ভালো করে পড়াশোনা করে এইচএসসিতেও জিপিএ-৫ পাই। আমাকে নিয়ে আবার প্রতিবেদন করেন। পরে আমাকে স্নাতক পর্যায়েও শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হয়। সেই বৃত্তির টাকা দিয়েই এমবিবিএস সম্পন্ন করি আমি।

ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তি পাওয়া ডা. আবু হোসাইন। গত ১২ মে অনলাইন অনুষ্ঠানে।

মনোবল শক্ত থাকলে সফলতা আসবেই। আবু হোসাইন প্রথমবার মেডিকেলে ভর্তি সুযোগ পনানি। কিন্তু তিনি ভেঙ্গে পডেন নি। পরের বছর আবার পরীক্ষা দিয়ে সাতক্ষীরা মেডিকেলে কলেজে ভর্তির সুযোগ পান। এখন পুরোদস্তুর চিকিৎসক হয়ে মানুষের সেবা করছেন। কেমন লাগে জানতে চাইলে আবু হোসাইন জানান, প্রতিকূলতার মধ্যে পড়ে পড়ে আজ আমি ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করছি, এটা যে কী ভালো লাগে-বলে বুঝানো যাবে না। তবে একটা আক্ষেপ আমার আছে। আমি পড়া অবস্থায় দাদা-দাদি মারা যান। তাঁদের সেবা করতে পারলে মন থেকে স্বস্তি পেতাম। সেটা পারিনি।

এখন স্বপ্ন হলো চিকিৎসা বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর বা বিশেষজ্ঞ ডিগ্রি অর্জন করা। আমি যেহেতু চিকিৎসা সেবার সঙ্গে জড়িত, তাই বিনা মূল্যে অসহায়দের চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাব।

বর্তমানে শিক্ষাবৃত্তি পাওয়া অদম্যদের উদ্দেশে আবু হোসাইন বলেন, যেকোনো প্রতিকূলতায় ভেঙে পড়া যাবে না। মনোবল শক্ত রাখতে হবে। আমরা তো প্রতিকূলতার মধ্যদিয়েই বড় হই। তাই যেকোনো বাধা মোকাবিলা করতে হবে। তখন সফলতা আসবেই।

কি স্বপ্ন দেখেন আবু হোসাইন জানতে চাইলে জানান, ‘ এখন স্বপ্ন হলো চিকিৎসা বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর বা বিশেষজ্ঞ ডিগ্রি অর্জন করা। আমি যেহেতু চিকিৎসা সেবার সঙ্গে জড়িত, তাই বিনা মূল্যে অসহায়দের চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাব। আর যারা অদম্য মেধাবী আছে প্রতিকূলতার মধ্যদিয়ে যাচ্ছে তাদের পাশে থাকার চেষ্টা করব।’