কারও বাবা ছিলেন দিনমজুর, কারও বাবা বর্গাচাষি কিংবা মুদিদোকানির। সেই ছেলেরাই বড় হয়ে চিকিৎসক হয়েছেন, ৩৯তম বিসিএসে নিয়োগের সুপারিশ পেয়েছেন। তাঁদের এই সফলতার সঙ্গে ছিল ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্টের অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তি। পড়ুন পরিশ্রম আর প্রাপ্তির গল্প।
বরিশালের গৌরনদী পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে নিলয় কুন্ডু যখন এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ–৫ পেল, তার মা-বাবার মুখে হাসির সঙ্গে কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজও ফুটে উঠেছিল। বাবা দিলীপ কুন্ডু ছোট্ট একটা মুদির দোকান চালান। মা চায়না রানী কুন্ডু বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রাইভেট পড়াতেন। জিপিএ–৫ পাওয়া ছেলেকে একটা ভালো কলেজে ভর্তি করবেন, মা-বাবার সেই সামর্থ্য কোথায়! দশম শ্রেণির বইগুলোর সঙ্গে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্নটাও তুলে রাখার কথা ভাবছিলেন নিলয়।
শেষ পর্যন্ত তার পথচলা কিন্তু সেখানেই থেমে যায়নি। গত ৩০ এপ্রিল প্রকাশিত ৩৯তম বিশেষ বিসিএসের ফল অনুযায়ী, সহকারী ডেন্টাল সার্জন পদে নিয়োগের জন্য সুপারিশ পেয়েছেন নিলয় কুন্ডু। তাঁর এই পথচলায় সঙ্গে ছিল ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্টের অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তি। স্নাতক, ডিপ্লোমা ও এইচএসসি পর্যায়ে এখন পর্যন্ত ৮৫০ জন অদম্য মেধাবীকে শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হয়েছে প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী তহবিল থেকে। ২০০৭ সালে শুরু হওয়া এই শিক্ষাবৃত্তি কার্যক্রমের সঙ্গে ২০১০ সালে যুক্ত হয় ব্র্যাক ব্যাংক। সহায়তা করছেন আরও অনেকে।
শুধু নিলয় কুন্ডু নন, এবার ৩৯তম বিসিএসের ফল হাতে পেয়ে সুখবর জানিয়েছেন ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্টের অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তি পাওয়া আরও দুজন—রাজশাহী মেডিকেলের মো. মাসুদ রানা ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলের মো. বিপুল মিয়া। মাসুদ রানা ও বিপুল মিয়া, দুজনই সহকারী সার্জন পদে সুপারিশ পেয়েছেন। এই উদ্যমী তরুণদের গল্প নিশ্চয়ই এ সময়ের শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা দেবে।
হাল ছাড়েননি রানা
নীলফামারীর মাসুদ রানা হয়তো রসায়নে স্নাতক হতে পারতেন। শিক্ষক হতে পারতেন। কিংবা মাধ্যমিকের পর হয়তো তাঁর আর পড়ালেখাই করা হতো না। কিন্তু চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন কখনোই যাঁর পিছু ছাড়েনি, সেই ছেলে ঠিকই তাঁর পথ খুঁজে নিয়েছেন।
নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলার খাটুরিয়া গ্রামের ভূমিহীন কৃষক ও দেবীগঞ্জ কৃষি ফার্মের নিয়মিত শ্রমিক মিলাল হকের ছেলে মাসুদ রানা। মা তাসলিমা বেগম গৃহিণী। দুই ভাইয়ের মধ্যে মাসুদ রানা ছোট। এসএসসিতে জিপিএ–৫ পেলেও দিনমজুর বাবার সামর্থ্য না থাকায় পড়ালেখা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল তার। প্রথম আলোয় সংবাদ প্রকাশের পর ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী তহবিলের সহযোগিতায় সে দেবীগঞ্জ ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হয়। ২০১০ সালে ওই কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের অধীনে পরীক্ষা দিয়ে জিপিএ–৫ পায়।
মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকের ফল ভালো হওয়ার পরও দুশ্চিন্তায় ছিলেন রানা। চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন ফিকে হয়ে আসছিল। কোচিং করা, পরীক্ষার ফরম তোলা, পদে পদে টাকার অঙ্ক চোখ রাঙানি দিচ্ছিল তাঁকে। পরিবারের সদস্যসংখ্যা ৬। বাবার জন্য সংসার চালানোই কঠিন। বাড়তি খরচ করার সাহস ছিল না। তাই মাসুদ রানা শিক্ষক হওয়ার কথা ভাবলেন। ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে। তারপর?
মাসুর রানা বলেন, ‘প্রথম আলো থেকে যখন জানানো হলো, উচ্চশিক্ষার বৃত্তির জন্যও আমাকে মনোনীত করা হয়েছে, তখন সাহস পেলাম। নতুন উদ্যমে চিকিৎসক হওয়ার জন্য পড়ালেখা শুরু করলাম। ২০১১-১২ সেশনে সুযোগ পেয়ে গেলাম রাজশাহী মেডিকেল কলেজে।’
নিজের পরিবারের দেখভালের পাশাপাশি দেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর স্বপ্ন নিয়ে চিকিৎসক হতে চেয়েছিলেন মাসুদ রানা। অসহায়ত্বের সময় একটু সহায়তাই যে একটা মানুষকে অনেক দূর এগিয়ে নিতে পারে, সেটা তো তিনি নিজের জীবন থেকেই শিখেছেন। সরকারি চিকিৎসক হিসেবে নিয়োগের সুপারিশ প্রাপ্তি নিশ্চয়ই তাঁর স্বপ্ন পূরণে আরও সহায়ক হবে।
বিপুল উদ্যম
‘ছোটবেলা থেকে আশপাশের মানুষকে এত সমস্যায় থাকতে দেখেছি, কষ্ট পেতে দেখেছি...তাই সব সময় ভাবতাম, সুযোগ পেলে মানুষের সেবা করব।’ মো. বিপুল মিয়ার এই মন্তব্য বুঝতে হলে একটু পেছনে তাকাতে হবে। বাবা মো. বাবুল মিয়া ছিলেন বর্গাচাষি। অন্যের জমিতে চাষ করে সংসার চালাতেন। মা খাদিজা বেগম গৃহিণী। ৩ ভাইবোনের মধ্যে বিপুল সবচেয়ে ছোট। বড় ভাই উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। বোনের বিয়ে হয়েছে। বর্গাচাষি বাবার পক্ষে সংসার চালানোই ছিল কঠিন।
বিপুল ভালো ছাত্র ছিল বলে স্কুলে বেতন দিতে হতো না। কিন্তু কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার তো খরচ আছে। মা-বাবা ধরেই নিয়েছিলেন, বড় ভাইয়ের মতো ছোটজনেরও বেশি দূর পড়ালেখা করার সুযোগ হবে না। তাই এসএসসিতে ছেলে জিপিএ–৫ পাওয়ার পরও তাঁরা খুশি হতে পারেননি। সে সময় প্রথম আলোর জামালপুর প্রতিনিধি বিপুল মিয়াকে নিয়ে পত্রিকায় প্রতিবেদন লেখেন। প্রথম আলো ট্রাস্টের সহযোগিতা ও দিকনির্দেশনায় উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়েও কৃতিত্বের সঙ্গে সাফল্য ধরে রাখেন। পরে উচ্চতর শিক্ষার জন্যও শিক্ষাবৃত্তি অব্যাহত রাখা হয়। কঠোর মনোবল নিয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলে পড়ার সুযোগ অর্জন করে নেন। এখন সরকারি চিকিৎসক হয়ে মানুষের কাছে যেতে পারবেন, সেবা করতে পারবেন, এটাই জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া বলে মনে করেন বিপুল।
প্রথম আলো ট্রাস্টের অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে বর্তমানে এমবিবিএস করছেন মোট ১৯ জন। সবার জীবনের ঘটনাই একই রকম অনুপ্রেরণাদায়ক। তাঁদের মধ্য থেকে নিশ্চয়ই আরও সাফল্যের গল্প উঠে আসবে।
সূত্র: ৯ জুন ২০১৯ তারিখে প্রথম আলোয় ছাপা হয়েছে।