চোখ নয়, মনের আলোয় স্নাতক সম্পন্ন করলেন রাজ্জাক

দৃষ্টি প্রতিবন্ধি অদম্য মেধাবী আব্দুর রাজ্জাক।

লালমনিরহাট জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম আদিতমারিতে জন্ম আব্দুর রাজ্জাকের। চোখে দেখেন না আব্দুর রাজ্জাক। কিন্তু জন্ম থেকেই তিনি দৃষ্টি প্রতিবন্ধি ছিলেন না। ৪ বছর বয়সে টাইফয়েড জ্বরে দৃষ্টিশক্তি হারান তিনি। দুই তিন বছর এভাবেই কেটে যায়। একদিন এলাকার ইউনিয়ন পরিষদের এক সদস্যের পরামর্শে সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালনায় প্রতিবন্ধীদের জন্য 'দৃষ্টি প্রতিবন্ধি শিক্ষা কার্যক্রম' স্কুলে ভর্তি হন রাজ্জাক।

সেই স্কুলেই তিনি প্রথম শ্রেণি থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত সরকারিভাবে আবাসিক হলে থেকেছেন, পড়াশোনা করেছেন। ২০১০ সালে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পান।

ফলাফল ভালো হওয়ায় প্রতিবন্ধি স্কুলের এক শিক্ষক তাঁকে সেই স্কুলেই রেখে দেন। তাঁর পড়াশোনার অদম্য ইচ্ছাশক্তি, ভালো ফলাফল বিবেচনায় তাঁকে 'ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তি' আওতায় নেওয়া হয়। সেই শিক্ষাবৃত্তি দিয়েই উচ্চমাধ্যমিকে পড়াশোনার খরচ চালান তিনি।

রাজ্জাকের সাফল্যের ধারাবাহিকতা ছিল উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফলেও। আবারও জিপিএ-৫ পান তিনি। পুনরায় তাঁকে স্নাতক পর্যায়ে চার বছরে জন্য 'ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তি' প্রদান করা হয়। এই শিক্ষাবৃত্তি সহযোগিতায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন তিন। সম্প্রতি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে স্নাতকোত্তরও সম্পন্ন করেছেন তিনি।

পড়াশোনা করার এই মনোবল বা সাহস কীভাবে পেলেন তাঁর উত্তরে তিনি বলেন, আমি যখন এসএসসি ও এইচএসসিতে ভালো ফলাফল করলাম, তখন আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল। তখন মনে হলো, আমি পড়াশোনা করতে পারব।' যদিও প্রথমে চেয়েছিলেন তিনি আইন বিষয়ে পড়াশোনা করবেন। পরে তাঁর বন্ধুরা যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হলেন, তখন তিনিও ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হলেন। যেহেতু তিনি ব্রেইল পদ্ধতিতে ( দৃষ্টিশক্তিহীনদের পড়ার বিশেষ ব্যবস্থা) পড়বেন, বন্ধুদের সঙ্গে পড়াশোনা করলে একসাথে পড়া, শুনে শুনে লেখাসহ সব বিষয়ে সহায়তা পাবেন।

দৃষ্টি প্রতিবন্ধি অদম্য মেধাবী আব্দুর রাজ্জাক।

আব্দুর রাজ্জাক বলেন,'সেশন জটের জন্য যদিও আমার পড়াশোনা শেষ করতে অনেক দেরি হয়ে গেল। তারপরও আমি একটি সরকারি চাকরির জন্য চেষ্টা করছি। আমাদের ব্রেইল পদ্ধতিতে চাকরির জন্য পড়াশোনার সেই অর্থে তেমন কোন সুবিধা নেই। চাকরি বিষয়ক পড়াশোনার পাঠ্য বইগুলো আমাদের আগে ব্রেইল করে নিতে হয়। তারপর পড়তে হয়। সেইভাবে আমি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। বাকিটা ওপরওয়ালার ইচ্ছা।'

তিনি আরও জানান, ' আমার বাবা-মা নিরক্ষর। কৃষিকাজ করে সংসার চলান। আমার বাবা-মা’র পরিবারের কেউ স্নাতকোত্তর পর্যন্ত আসতে পারেনি। সেই দিক থেকে আমিই আমার বংশের প্রথম স্নাতকোত্তর সম্পন্নকারী ব্যক্তি। এই বিষয়টিতে আমার বাব-মা বেশ গর্ববোধ করেন। আমি যেন তাঁদের মুখ আরও উজ্জ্বল করতে পারি। যেহেতু এখনও আমি চাকরি পাইনি, সামনে দিনগুলোতে কি হবে তা নিয়ে তাঁরা মাঝে মধ্যে চিন্তাও করেন। আমি শুধু চাই, আমি নিজে যেহেতু দেখতে পাই না, আমার কাজের মাধ্যমে সবাই যেন আমাকে দেখতে পারে। কেবল দৃষ্টিশক্তিহীন বলে নয়, বরং নিজের যোগ্যতায় কাজ করে নিজেকে প্রমাণ করতে চাই।'