আমি ঝিনাইদহের একটি গ্রামে বড় হয়েছি। এখানেই প্রাথমিক শিক্ষা শেষে করি। পরে ঝিনাইদহ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০০৭ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাই। ওই বছর আমরা ২৬ জন জিপিএ-৫ পাই। এই সংবাদ কভার করার জন্য প্রথম আলো প্রতিনিধি ছবি তুলতে যান। সবাই যখন ছবি তোলার জন্য পোজ দিতে রেডি, আমি তখন অনুপস্থিত ছিলাম। স্কুল ড্রেস পড়ে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু আমার কোনো স্কুল ড্রেস ছিল না। আমি যেহেতু সব বিষয়ে গ্রেড এ+ পেয়েছিলাম, সে জন্য সবাই আমাকে খোঁজতে ছিল। পরে একজনের কাছ থেকে শার্ট নিয়ে ছবি তোলার লাইনে দাঁড়াই। কথাগুলো বলছিলেন রিজভী আহমেদ সবুজ।
সবুজ বলেন, আমাকে নিয়ে প্রথম আলোতে প্রতিবেদন ছাপা হয়। পরে অনেকেই প্রথম আলোর মাধ্যমে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। অনেক সহায়তা করে। আমাকে প্রথম আলো থেকে শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হয়। এই বৃত্তি সহায়তা নিয়ে ঝিনাইদহ সরকারি কে.সি কলেজে ভর্তি হই। প্রথম আলো থেকে টানা দুই বছর শিক্ষাবৃত্তি চালিয়ে যায়। যার দরুন আমি পড়াশোনা ভালোভাবে করতে পেরেছি।
পরিবারে অভাব ছিল চরম, কিন্তু লক্ষ্যে অটল ছিলেন রিজভী আহমেদ সবুজ। তার ফলও পেয়েছেন হাতে হাতে। প্রথম আলোর একটা রিপোর্ট এবং বৃত্তির সহযোগিতা তাকে বদলে দিয়েছে। রিজভী এখন কর্মরত আছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিপার্টমেন্ট অব কমিউনিকেশনস অ্যান্ড পাবলিকেশনস বিভাগের কর্মকর্তা হিসেবে। সম্প্রতি প্রকাশিত ৪০তম বিসিএসে (প্রশাসন) সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন।
তাঁর এই সফলতার গল্প ওঠে আসে ০৯ এপ্রিল ২০২২,শনিবার, বেলা ৩টা ৩০মিনিটে প্রথম আলো ট্রাস্টের নিয়মিত আয়োজন ‘অদম্য মেধাবীর সঙ্গে’ অনলাইন অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানটি একযোগে প্রচার করা হয় প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ইউটিউব চ্যানেল এবং প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ফেসবুক পেজ থেকে। সঞ্চালনায় ছিলেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা।
আমাকে নিয়ে প্রথম আলোতে প্রতিবেদন ছাপা হয়। পরে অনেকেই প্রথম আলোর মাধ্যমে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। অনেক সহায়তা করে। আমাকে প্রথম আলো থেকে শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হয়।
অনুষ্ঠানে সবুজ বলেন, ‘আমার পরিবারের অবস্থা অনেক শোচনীয় ছিল। বাবার জমাজমি বলেতে কিছুই ছিল না। তিন ভাই পড়াশোনা করি তখন। এর মধ্যে ২০০৯ সালে এইচএসসি পরীক্ষা দিলে একটুর জন্য জিপিএ-৫ পাইনি আমি। তবে ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়ে কুষ্টিয়াতে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হই। এ সময় প্রথম আলোর সংবাদ দেখে ব্র্যাক থেকে আমাকে স্নাতকের জন্য আড়াই বছর সহায়তা প্রদান করে। নিজের খরচ ও পরিবারকে কিছু সহযোগিতার দেওয়ার জন্য আমি সকাল ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত টিউশনি করেছি। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস পরীক্ষাও দিয়েছি। এভাবেই কঠোর পরিশ্রম করে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন চলে।’
এরই মধ্যে সবুজ তাঁর স্কুলের প্রধান শিক্ষক নাজেদা নাহারের অবদানের কথাও স্মরণ করলেন। তিনি নানাভাবে পরামর্শ ও আর্থিক সহায়তা করে পথ এগিয়ে দিয়েছেন। এ ছাড়া স্কুল কলেজে কোনো শিক্ষক তাঁকে পড়ানোর জন্য কোনো টাকা নেয়নি, সেটাও কৃতজ্ঞতা ভরে মনে করলেন তিনি।
কি স্বপ্ন দেখেন সবুজ? জানতে চাইলে জানান, ‘স্বপ্ন একটাই, আমরা যারা সমাজে সুবিধাবঞ্চিত আছি,যারা সুযোগের অভাবে বিকশিত হতে পারে না তাদের পাশে দাঁড়াব। এটা শুরু করব নিজ এলাকা থেকে।’
মা-বাবার অনুভূতি সম্পর্কে জানালেন, তাঁরা অনেক খুশি। বড় দুই ভাইও অনেক খুশি। সবুজ পরিবারে ছোট হলেও, পরিবারে অনেক কিছু তিনিই দেখভাল করেন।
সবাই যখন ছবি তোলার জন্য পোজ দিতে রেডি, আমি তখন অনুপস্থিত ছিলাম। স্কুল ড্রেস পড়ে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু আমার কোনো স্কুল ড্রেস ছিল না।
সবুজ জানালেন, জীবনে যখন প্রতিকূলতা এসেছে সেটাকে পাত্তা দিতাম না। নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করেছি সব সময়। একটা চিন্তা ছিলে, আমাকে দাঁড়াতে হবে। কারণ, ছোট থেকেই পরিবারে অভাব দেখে দেখে বড় হয়েছি। তাই আমার মনে হয়েছে, পরিবারের অবস্থা পরিবর্তন করতে হলে পরিশ্রমের বিকল্প নাই।
বর্তমানে শিক্ষাবৃত্তি পাওয়া অদম্যদের উদ্দেশে সবুজ বলেন, যেকোনো প্রতিকূলতায় ভেঙে পড়া যাবে না। মনোবল শক্ত রাখতে হবে। মনের মধ্যে যে টার্গেট আছে সেটা পূরণ করতেই হবে-এ ধরনের মানসিকতা থাকতে হবে। তখন সফলতা আসবেই। সব শেষে প্রথম আলোকে ধন্যবাদ জানান এ ধরনের একটা সুন্দর আয়োজনে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য।