দুর্দিন থেকে সুদিনের দেখা পেলেন অদম্য সারমিন

অদম্য মেধাবী সারমিন আক্তার।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার বালিয়াডাঙা ইউনিয়নের মেয়ে সারমিন আক্তার। বসতভিটে ছাড়া তাদের কোনো জায়গা জমি নেই। অভাবে সংসারে বাবা কৃষিকাজ ও দিনমজুরি করে সংসার চালান। চার ভাই বোনের মধ্যে সারমিন দ্বিতীয়। বড় বোনের বিয়ে হয়েছে, ছোট বোনও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিভাগে পড়াশোনা করেছেন। আর একমাত্র ভাই এ বছর এসএসসি পরীক্ষা দেবে।

বাবার অল্প আয়ে বড় সংসার চালানোই যেখানে কঠিন, সেখানে পড়াশোনা করাটা বিলাসিতার মতো। কিন্তু মনের মধ্যে যার পড়াশোনার আকুতি, তাঁকে কি আর আটকানো যায়! সারমিনও তাই। কঠোর মনোবল নিয়ে পড়াশোনা করেছেন, হয়েছেন সফল। এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্টের অদম্য মেধাবী তহবিল থেকে শিক্ষাবৃত্তি পান। এইচএসসি পুনরায় সাফল্য ধরে রাখলে স্নাতক পর্যায়েও শিক্ষাবৃত্তি দেয় এই তহবিল।

শিক্ষকদের সহায়তায় ২০০৮ এ এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাই। পরে প্রথম আলো পাশে দাঁড়ায়। চলার পথ সহজ হয়। এভাবে এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পাই : অদম্য সারমনি আক্তার।

এভাবে শিক্ষাবৃত্তির সহায়তায় পড়াশোনা করে ২০১০-১১ সেশনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভেটেরিনারি মেডিসিন বিভাগে (ডিভিএম) ভর্তি হন। কিন্তু মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার জন্য ১ বছর ড্রপ দেন। মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ না হওয়ায় পুনরায় ২০১১-১২ সেশন থেকে ডিভিএম বিভাগে নিয়মিত হন। এখান থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে বর্তমানে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের আমারক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত তিনি। এ ছাড়া বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন নিয়মিত।

প্রথম আলো ট্রাস্টের নিয়মিত অনলাইন আয়োজন 'অদম্য মেধাবীর সঙ্গে’ অনুষ্ঠানের অতিথি হয়ে এসেছিলেন সারমিন আক্তার। গত ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, শনিবার, বিকেল ৫টায় এ অনুষ্ঠানে তাঁর সফল হওয়া ও স্বপ্নের কথা জানালেন তিনি।

গত সেপ্টেম্বরে বিসিএস নন-ক্যাডারভুক্ত হয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন সারমিন। নতুন চাকরি কেমন লাগছে? এর উত্তরে সারমিন বলেন, ‘প্রথমেই আপনাদের ধন্যবাদ জানাই। ছোট বাচ্চাদের সঙ্গে কাজ করছি—এটা অনেক ভালো লাগছে।

ছোটবেলা কেমন ছিল? এ বিষয়ে সারমিন জানান, ‘আমার ছোটবেলায় অনেক সংগ্রাম যুক্ত ছিল। বাবা বিদেশে ছিলেন, ফেরত আসেন। একটা হার্ডওয়্যারের দোকানে কাজ নেন। সেখানে কাজ করতে গিয়ে পড়ে পা ভেঙে যায়। প্রায় ২ বছর বিছানায় থাকতে হয় তাঁকে। দাদা আগে থেকেই পক্ষাঘাতগ্রস্ত ছিলেন। তখন খুব খারাপ সময় গেছে আমাদের। দুবেলা খাবারের ব্যবস্থায়ও ছিল না আমাদের। তখন মা ও আমি মিলে অন্যের ধান সিদ্ধ করে শুকিয়ে চাল বানিয়ে দিয়ে কিছু চাল পেতাম, সেগুলো বাসায় নিয়ে আসতাম। যা হোক আমি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভর্তি হই। শিক্ষকদের উৎসাহে পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পাই। হাইস্কুলে যাই। শিক্ষকদের সহায়তায় ২০০৮ এ এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাই। পরে প্রথম আলো পাশে দাঁড়ায়। চলার পথ সহজ হয়। এভাবে এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পাই। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ভর্তি হই। শিক্ষক ও প্রথম আরও ট্রাস্টের অদম্য মেধাবী তহবিলের সহযোগিতায় এগিয়ে গেছি।’

স্বপ্নটা কি ছিল আপনার? এ ব্যাপারে সারমিন জানান, ‘ছোটবেলায় স্বপ্ন ছিল পেট ভরে খাওয়ার জন্য চাকরি করব। অভাবের সংসারে বড় বোন পড়াশোনা করতে পারেননি। বিয়ে হয়ে গেছে বেশ আগেই।’

এখন বাবা-মা কি বলেন আপনাকে নিয়ে? সারমিনের সহজিয়া উত্তর, ‘পিতার পরিচয়ে সন্তানেরা পরিচিত হয়। এখন আমাদের পরিচয়ে বাবা পরিচিত হন। সারমিনের বাবা বলে চেয়ার ছেড়ে দেন। এটা অনেক সম্মানের এবং ভালো লাগার বিষয়।’

‘অনেক সময়ই মনে হয়েছে, আর পারব না। তবে ইচ্ছা থাকলে যেকোনো অবস্থা থেকে মানুষ সফল হতে পারে। আমিও পেরেছি।’

গত সেপ্টেম্বর যোগদান করেছেন। এখন স্বপ্ন কি? এর উত্তরে সারমিন বলেন, বেশ আনন্দ নিয়ে শিক্ষকতা করছি। এ ছাড়া ৪৪ তম বিসিএসের ভাইভা বাকি, ৪৫ তম’র লিখিত দিয়েছি—জানি না কি হবে। তবে এই শিক্ষকতা পেশায় যদি থাকি, তাহলে আমার শিক্ষক ও প্রথম আলো যেভাবে আমাকে সহযোগিতা করেছে আমিও সহযোগিতা করব। আমার স্কুলটা খাস জমিতে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর এলাকাটিতে তাদের কোনো উচ্চাকাঙ্খা নেই। আমার জীবনের গল্পগুলো, কথাগুলো তাদের কাছে শেয়ার করব। যাতে তারাও জীবনকে সুন্দর করতে পারে।’

এখন যারা অদম্য মেধাবী আছেন তাদের জন্য সারমিনের পরামর্শ হলো, ‘মানসিকভাবে কোনোভাবেই ভেঙে পড়া যাবে না। শক্ত মনোবল থাকলে সবকিছুই অর্জন সম্ভব। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। এভারেস্ট বিজয়ী একজন ছিলেন। তখন মনে হয়েছে—উনি পারলে, আমি কেন পারব না। স্বপ্ন তুমি দেখে যাও—পথই তোমাকে নিয়ে যাবে।’

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের আমারক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত অদম্য সারমিন আক্তার।

আর হবে না, পারব না—এ রকম কি মনে হয়েছে কখনো? সারমিন বলেন, ‘অনেক সময়ই মনে হয়েছে, আর পারব না। তবে ইচ্ছা থাকলে যেকোনো অবস্থা থেকে মানুষ সফল হতে পারে। আমিও পেরেছি।’

অনুষ্ঠান শেষে সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে সারমিন বলেন, ‘প্রথম আলো, ব্র্যাক ব্যাংককে অসংখ্য ধন্যবাদ। তারা পাশে না থাকলে আমরা এই অবস্থায় আসতে পারতাম না।’

অনলাইন এই অনুষ্ঠানটি একযোগে প্রচার করা হয় প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ইউটিউব চ্যানেল এবং প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ফেসবুক পেজ থেকে। সঞ্চালনায় ছিলেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা।