খুলনার কয়রা উপজেলায় গোপাল বাছাড়ের বাড়ি। দুই ভাই ও মা-বাবাসহ ৪ জনের পরিবার। ভাইয়ের মধ্যে গোপাল বড়, ছোট ভাইও পড়াশোনা করে। বাবা কৃষি কাজ করে সংসার চালান। মা গৃহিণী। একমাত্র উপার্জনকারী বাবার আয় ছিল খুবই সীমিত, যা দিয়ে কখনোই সবার পড়াশোনার খরচ চালানো সম্ভব হতো না। এই পরিবার থেকে কীভাবে চিকিৎসক হলেন গোপাল, এখনই বা কি করছেন — এ সবকিছু নিয়ে গোপাল বাছাড়ের জীবনের নানা গল্প উঠে আসে ১২ অক্টোবর ২০২২, বুধবার, বিকেল ৫টা ৩০মিনিটে প্রথম আলো ট্রাস্টের নিয়মিত আয়োজন ‘অদম্য মেধাবীর সঙ্গে’ অনলাইন অনুষ্ঠানে।
গোপাল বাছাড় ‘ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী’ শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে এইচএসসি ও স্নাতক পর্যায়ে পড়াশোনা করেছেন। এইচএসসি পাসের পর ২০১২-১৩ সেশনে কোথাও ভর্তির সুযোগ না পেয়ে পরের বছর আবার পরীক্ষা দেন। এ বছর মেডিকেল ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপেক্ষমাণ তালিকায় থাকেন। পরে খুলনার বেসরকারি মেডিকেল গাজী মেডিকেল কলেজে দরিদ্র মেধা কোটায় ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। এখান থেকে এমবিবিএস পাস করে গাজী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। দুই বছর চাকরি করার পর স্নাতকোত্তর পর্ব-১ এ ভর্তির প্রস্তুতির জন্য চাকরি ছেড়ে দেন। এখন এফসিপিএস পর্ব-১ এ ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে চলেছেন।
সব সময় বাবা-মার কথা চিন্তা করেছি। মনে একটাই চিন্তা ছিল, হাল ছেড়ে দিলে হবে না। অনেকের অবদানের ফসল ছেড়ে দিলে অনেককে মনঃকষ্ট দেওয়া হবে।
ছোটবেলা কেমন ছিল জানতে চাইলে গোপাল বলেন, ‘ আমি গোপাল বাছাড়। আমার বাবা কৃষি কাজ করেন। দুই ভাইয়ের মধ্যে আমি বড়। অভাবের সংসারে অনেক কষ্টের মধ্যদিয়ে আজকের ডা. গোপাল হতে পেরেছি। এ জন্য মায়ের কৃতিত্ত্বই বেশি। বাবাও চাইতেন আমি ডাক্তার হই। মা-বাবা ছাড়াও অনেকই আমার পাশে ছিলেন। আজকের ডা. গোপাল বাছাড় হওয়ার জন্য যাঁরা আমার পাশে ছিলেন তাদের ধন্যবাদ জানাই।’
পরক্ষনে যুক্ত করে বলেন, ‘অষ্টম শ্রেণি পাস করার পর নবম শ্রেণিতে উঠতে গিয়ে অনেক সমস্যা হয়। আমার ইচ্ছে বিজ্ঞান বিভাগে পড়ব। কিন্তু বিজ্ঞান বিভাগে খরচ বেশি, কীভাবে মেটাব! তাই খরচ কমানোর জন্য মানবিক বিভাগ নিতে চাইলাম। ভালো ফল করায় শিক্ষকগণ বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার পরামর্শ দিলেন। পরে শিক্ষকদের সহযোগিতায় নিজে সাহস নিয়ে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হলাম। অনেক শিক্ষক আমাকে বছরের পর বছর ফ্রি পড়িয়েছেন। সবার সহযোগিতায় এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পাই।’
যখন এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেলেন তখন কি ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন ছিল? এর উত্তরে গোপাল বলেন, বাবা চাইতেন ডাক্তার হই। আমার স্কুলের সহকারী শিক্ষক বাছাড় স্যার আমাকে প্রথম আলো ট্রাস্টের শিক্ষাবৃত্তির কথা জানান। তাঁর কথামতো এখানে বৃত্তির জন্য আবেদন করি। পরে এইচএসসি পর্যায়ে দুই বছর পড়াশোনার জন্য ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তি পেয়ে যাই। এই বৃত্তি আমাকে মানসিকভাবে সাহস যোগায়। যার কারণে এইচএসসি চূড়ান্ত পরীক্ষাতেও জিপিএ-৫ পাই। সাফল্য ধরে রাখার জন্য আমাকে পুনরায় স্নাতক পর্যায়েও শিক্ষাবৃত্তির জন্য মনোনীত করে প্রথম আলো ট্রাস্ট। তাদের দেওয়া সাহসেই আজ আমি ডাক্তার গোপাল হতে পেরেছি।’
এমবিবিএস পড়াশোনা বেশ কঠিন। পুরো সময়টাতে নিজের মনোবল ধরে রাখলেন কীভাবে? এর উত্তরে গোপাল বাছাড় জানান, ‘আসলে মেডিকেল ভর্তির বিষয়টা কঠিন। আমি আমার কয়েকজন শিক্ষকের মাধ্যমে দরিদ্র মেধা কোটায় গাজী মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস ভর্তি হই। পাস করার পর এখানেই দুই বছর চাকরি করেছি। এখন স্নাতকোত্তর ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছি।মানুষের সেবা করে পাশে দাঁড়াতে চাই আমি।’
সব কিছুর মধ্যে পরিশ্রম। পরিশ্রম করলে সফল হবেই। যারা আমার মতো প্রথম আলো ট্রাস্টের সহযোগিতা পেয়েছে —তাদের বলব, মনোবল শক্ত রাখতে হবে।
মা-বাবার অনুভূতির কথা বলতে গিয়ে গোপাল বলেন, তাঁরা অনেক খুশি। তাদের আশা পূরণ করতে পেরেছি। পাশাপাশি যাঁরা আমাকে এই পথ পাড়ি দিতে সহযোগিতা করেছেন তাঁদের সম্মানও রাখতে পেরেছি। এটাই ভালো লাগার জায়গা।’
পুরো জার্নিতে যে বাধাগুলো এসেছে সেগুলো সামলে নিলেন কিভাবে জানতে চাইলে গোপালের অকপট উত্তর—সব সময় বাবা-মার কথা চিন্তা করেছি। মনে একটাই চিন্তা ছিল, হাল ছেড়ে দিলে হবে না। অনেকের অবদানের ফসল ছেড়ে দিলে অনেককে মনঃকষ্ট দেওয়া হবে। সবদিক চিন্তা করে এগিয়েছি, বাধাগুলো অতিক্রম করেছি।
ছোট অদম্যদের জন্য কি পরামর্শ দেবেন? এ ক্ষেত্রে গোপাল বলেন, ‘ সব কিছুর মধ্যে পরিশ্রম। পরিশ্রম করলে সফল হবেই। যারা আমার মতো প্রথম আলো ট্রাস্টের সহযোগিতা পেয়েছে —তাদের বলব, মনোবল শক্ত রাখতে হবে। একবার ব্যর্থ হলে পরের বার দ্বিগুণ পরিশ্রম করে অতিক্রম করতে হবে। এর বিকল্প নেই।’
প্রথম আলো ট্রাস্টের নিয়মিত আয়োজন ‘অদম্য মেধাবীর সঙ্গে’ অনলাইন এই অনুষ্ঠানটি একযোগে প্রচার করা হয় প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ইউটিউব চ্যানেল এবং প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ফেসবুক পেজ থেকে। সঞ্চালনায় ছিলেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা।