জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে গ্রামের মোরে ছোট চায়ের দোকান করতেন রকিবুল ইসলামের বাবা। অসুস্থ থাকায় এখন (২০২৪ সাল) আর করেন দোকান করতে পারেন না। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে রকিবুল বড়। ছোট ভাই স্থানীয় কলেজে ডিগ্রি পড়ছে। টিউশনি করে, কোচিংয়ে ক্লাস নিয়ে কিছু আয় করে ছোট ভাই। বোন স্কুলে পড়ে। রকিবুল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে বর্তমানে ইনস্টিটিউট অফ ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম) জিআইএস এনালিস্ট হিসেবে চাকরি করছেন। তিনি আর তাঁর আর ছোট ভাই মিলে পরিবারে খরচ জোগান।
প্রথম আলো ট্রাস্টের নিয়মিত আয়োজন ‘অদম্য মেধাবীর সঙ্গে’ অনলাইন অনুষ্ঠানে এ পর্বের অতিথি ছিলেন অদম্য মেধাবী মো. রকিবুল হাসান। ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, শনিবার, বেলা ৩টায় তার জীবনের নানা সংগ্রাম, সফলতার গল্প তুলে ধরলেন এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে।
একমাত্র পড়াশোনা করেই জীবনকে পরিবর্তন করা সম্ভব। তাই যত বাধাই আসুক আমি আমার লক্ষ্যে পৌঁছাবই। সেখান থেকেই দৃঢ় মনোবল নিয়ে এগিয়েছি— অদম্য রকিবুল হাসান।
অনুষ্ঠানে ছোটবেলার গল্প বলেতে গিয়ে রকিবুল বলেন, ‘বাবা চায়ের দোকান করতেন। অন্যদের মতো আমার তেমন সুযোগ ছিল না। অন্যরা সাইকেলে স্কুলে গেলেও আমি ভোর ৬টা ওঠে হোমওয়ার্ক শেষ করে ৮ কিলোমিটার হেঁটে স্কুলে যেতাম। ষষ্ঠ থেকে এসএসসি পর্যন্ত প্রতিদিন ৮ কিলোমিটার করে ১৬ কিলোমিটার যাতায়াত করতাম হেঁটে। ৫ টাকা ভাড়া দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না। সবাই টিফিন করলেও আমি করতে পারতাম না। স্কুলের নিকটবর্তী নানি বাড়িতে গিয়ে খেয়ে আসতাম।’
পরক্ষণে রকিবুল যোগ করে বললেন, ‘ষষ্ঠ থেকে দশম পর্যন্ত রোল ১ ছিল আমার। আমার শিক্ষকেরা আমার পারিবারিক অবস্থা জানত। তাই শিক্ষকেরা অনেক সহায়তা করেছেন। আমাকে কোনো টিউশন ফি দিতে হতো না। যখন এসএসসি পরীক্ষা সময় এল, তখন ফরম পূরণের টাকা ছিল না। কোনোমতে বোর্ড ফি-টার ব্যবস্থা করতে পেরেছিলাম। পরে শিক্ষকেরা চাঁদা দিয়ে আমার ফরম পূরণ করিয়ে দেন। সবার সহায়তা আমি ২০১০ সালে এসএসসিতে মানবিক বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়ে জেলায় প্রথম স্থান অধিকার করি।’
রকিবুল জানালেন, ‘ভালো ফল করায় শিক্ষকেরা অনেক খুশি হন। কিন্তু আমার মনে ছিল দু: চিন্তা। কীভাবে কলেজে ভর্তি হব! ওই সময়টাতে প্রথম আলোর জেলা প্রতিনিধি আমাদের বাসায়ে আসেন। সব দেখে আমাকে নিয়ে প্রতিবেদন করেন। পরে আমার পারিবারিক অবস্থা বিবেচনায় আমাকে ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হয়। আমি নতুন করে এগিয়ে যাওয়ার সাহস পাই। ভর্তি হই সরিষাবাড়ী কলেজে। আমাদের ঢাকা এনে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে এসে অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তির সান্নিধ্য পাই। অনুপ্রেরণা পাই। অনুষ্ঠানে জানানো হয়, আবার ভালো করলে স্নাতকেও বৃত্তি দেওয়া হবে। এটাকেই আমি সুযোগ হিসেবে নিয়েছি। সাহস পেয়েছি। আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হবে—এই স্বপ্ন সামনে নিয়ে ভালো করে পড়াশোনা করি এবং ২০১২ সালে এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পাই। আমাকে স্নাতক পর্যায়ের বৃত্তির জন্যও মনোনীত করা হয়।’
রকিবুল ২০১২-১৩ সেশনে আনন্দমোহন কলেজে (ময়মনসিংহ) অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন। পরের বছর ২০১৩-১৪ সেশনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগে সুযোগ পান। রকিবুল বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর আবার আমাদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেখানেও অনেক দিক নির্দেশনা পাই। বলতে গেলে এই বৃত্তির মাধ্যমেই টিকে ছিলাম। যার জন্য দারিদ্র্য বাধা হতে পারেনি। আজীবন এটা মনে রাখব আমি। প্রথম আলো এবং এর সঙ্গে যুক্ত সবার প্রতি কৃতজ্ঞ।’
বাবা-মায়ের অনুভূতি কেমন এখন? উত্তরে বললেন, ‘ছোটবেলার একটা ঘটনা বলি, স্কুল ড্রেস বানাতে হবে। বাবাকে বললাম, দুই দিনের মধ্যে স্কুল ড্রেস বানাতে হবে। কিন্তু বাবা তা ম্যানেজ করতে পারেনি। পিটি ক্লাসে দেখা যায়, সবার স্কুল ড্রেস আছে, শুধু আমি ছাড়া। সে জন্য আমি বেতের বাড়ি খাই। কষ্টে অনেক কান্নাকাটি করি। পরে ধার করে ড্রেসটা বানিয়ে দেন বাবা। যা হোক সবকিছু মোকাবিলা করে আজকে আমি কর্মস্থলে প্রবেশ করেছি। বাবা-মা অনেক খুশি এতে। গ্রামে আমাকে আদর্শ হিসেবে দেখে, আমার কাছে অনেকেই আসে। তখন খুব গর্ববোধ হয়।’
স্বপ্নের কথা বলতে গিয়ে রকিবুল বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে একটা কম্পিউটার থাকলে ভালো হয়। আমার ছিল না। বন্ধুদের কম্পিউটারে কাজ করেছি। এখন নিজের ইনকাম দিয়ে একটা ডেস্কটপ কম্পিউটার কিনেছি। এটা একটা ভালো লাগা আমার। আমার স্বপ্ন—দেশের বাইরে গিয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে জিআইএসে প্রো হতে চাই।’
মনোবল ধরে রাখলেন কীভাবে? এর উত্তরে রকিবুল বলেন, অনেক সময় মনে হয়েছে, হয়তো পড়াশোনা করা সম্ভব হবে না। অনেকই বলত, কাজ কর। টাকা আয় কর। তখন ভেবেছি, দিনমজুরি করেই জীবন কাটিয়ে দেব। তবে মনের ভেতর আগুন ছিল, যেটা বলত—একমাত্র পড়াশোনা করেই জীবনকে পরিবর্তন করা সম্ভব। তাই যত বাধাই আসুক আমি আমার লক্ষ্যে পৌঁছাবই। সেখান থেকেই দৃঢ় মনোবল নিয়ে এগিয়েছি। যারা মনে করেন আমাকে দিয়ে কিছু হবে না। তাদের বলব, মেঘ দেখে কেউ করিস নে ভয়. . আড়ালে তার সূর্য হাসে। পরিশ্রম করলে সফলতা আসবেই।’
অনলাইন এই অনুষ্ঠানটি একযোগে প্রচার করা হয় প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ইউটিউব চ্যানেল এবং প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ফেসবুক পেজ থেকে। সঞ্চালনায় ছিলেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা।