সাক্ষাৎকার

‘জীবনে সফল হতে হলে ধৈর্যসহকারে কাজ করে যেতে হবে’

প্রথম আলো ট্রাস্টের নিয়মিত আয়োজন ‘অদম্য মেধাবীদের সঙ্গে’। এই আয়োজনে আমরা সেই অদম্য মেধাবীদের সঙ্গে কথা বলি যিনি তার আর্থিক, সামাজিক ও পারিবারিক নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে এখন সফল হয়েছেন, নিজের স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে যাচ্ছেন। এমনি একজন অদম্য মেধাবীকে নিয়ে গত ১৫ মে ২০২৫, বিকেল ৫টায় আয়োজন করা হয় ‘অদম্য মেধাবীদের সঙ্গে’ অনলাইন অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের এ পর্বের অতিথি ছিলেন ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য তহবিল থেকে শিক্ষাবৃত্তি পাওয়া গোপালগঞ্জ সদরের অসহায় ও দরিদ্র পরিবারের অদম্য মেধাবী মাসুবা আক্তার আশা। তিনি গোপালগঞ্জ সরকারি কলেজ থেকে ইসলামের ইতিহাসে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। এখন ফ্রিল্যান্সিং করে উপার্জন করছেন। নিজেকে একজন সফল ফ্রিল্যান্সার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা। সাক্ষাৎকারটি অনুলিখন করেছেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সহকারী ব্যবস্থাপক মো. নাজিম উদ্দিন।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

আশা স্বাগতম, কেমন আছেন?

মাসুবা আক্তার আশা: আলহামদুলিল্লাহ আমি ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

ভালো আছি আশা। অভিনন্দন আপনাকে। আপনি ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করছেন। একদম শুরুতেই আপনার ছোটবেলার গল্প শোনার আগে একটু জেনে নিতে চাই, ফ্রিল্যান্সার হওয়ার অনুপ্রেরণা কই থেকে পেলেন?

মাসুবা আক্তার আশা: এটা বলতে গেলে প্রথমে বলব যে, এর উৎসাহ দিয়েছে আমার আম্মু। আমি মোটামুটি ডিজাইন করতে পারি। তা আম্মু জীবনের গল্প নামে একটা অনুষ্ঠান দেখত। আমি মোবাইল কি জিনিস জানতাম না। প্রথম যখন আমি মোবাইল পেলাম ২০১৯ সালে তখন মাঝে মাঝে একটু ব্যবহার করতাম। ইউটিউব, ফেসবুক ব্যবহার করতাম না। তখন মনে করতাম যে ফেসবুক ব্যবহারটা ভালো না। পরে জীবন গল্পের কিছু কিছু অংশ আমি ইউটিউবে দেখতাম। আবার ভয় পেতাম, আম্মু যদি রাগ করে। সে জন্য আর অতটা দেখতাম না। হঠাৎ করে একদিন কথায় কথায় আম্মুকে ওই গল্পটা দেখাই। ওখান থেকে আম্মু খুব পছন্দ করে। আম্মু সারা দিন চাকরিতে থাকত। রাত্রে এসে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত গল্পটা দেখত। তো ওইখানে এক ফ্রিল্যান্সারকে দেখেন। দেখেই ওটা খুব ভালো লাগল। আর যেহেতু আমি পড়াশোনা করেছি ঠিকই কিন্তু আমি শারীরিকভাবে কিছুটা অসুস্থ। তাই আম্মু বললেন, ফ্রিল্যান্সারের কাজটা ঘরে বসে স্বাধীনতাভাবে করতে পারবে তুমি। তোমার কোন চাপ থাকবে না। তা ছাড়া আমি ভালো ডিজাইন করতে পারি, সে জন্যই এই প্রফেশনালে আসা।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

বাহ! খুবই ভালো। এই গল্পটা নিশ্চয়ই আরেকটু বড় করে শুনব। তার আগে একটু শুনব মাসুবার ছোটবেলার গল্প। আসলে ছোটবেলার পথচলাটা কেমন ছিল?

মাসুবা আক্তার আশা: আসলে ছোটবেলাটা খুব কষ্টে কেটেছে। কারণ আমি যখন দুই মাসের পেটে তখন ব্লাড ক্যানসারে আমার বাবা মারা যায়। তখন থেকে আমার আম্মুর একা পথ চলা। আমার আম্মু কখনো বিয়ে করেনি। আমি হওয়ার পরে নানা-নানির কাছে মানুষ হয়েছি আমি। অনেক কষ্টে আমার আম্মু কাজ করত। এমন দিন গেছে আমি সামান্য কিছু খেয়েছি, আমার আম্মু খাইতে পারে নাই। আম্মু জমিতেও কাজ করেছে। যে কষ্টের কোন শেষ নাই। তবুও আমার আম্মু বিয়ে করেনি। অনেক কষ্ট করে আমার আম্মু আমারে পড়াশোনা শিখাইছে। এসএসসি পরীক্ষায় আমি ফরম-পূরণ করতে পারিনি। সবাই মিলে টাকা দিয়েছে। আমার আম্মুর বলত, আর যাই করো অন্ততপক্ষে ভালো রেজাল্ট যেন আসে। জিপিএ-৫ কি, আমি সেটাই ভালোভাবে জানতাম না। একটা প্রাইভেটও আমি পড়িনি। নিজে নিজে প্রশ্ন ও নোট জোগাড় করে আবার সাজেশন করতাম। স্যারেরা নিয়মিত ক্লাসে যেটা পড়াত সেটা আমি প্রতিদিন নোট করে পড়ে ফেলতাম। যা হোক আমি আমার আম্মুকে হতাশ করিনি। আল্লাহর রহমতে আমার রেজাল্ট ভালো আসে। আমি জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি পাস করি। আমার টিচাররাও আমাকে খুব ভালোবাসে। আমার বান্ধবীরাও আমাকে খুব ভালোবাসে। এভাবেই আমার পথ চলা। এসএসসি পরীক্ষার পরে আমার জীবনে প্রথম আলো আসল। এর আগে প্রথম আলোকে আমি চিনতাম না। প্রথম আলোর তখনকার গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি মাধ্যমেই আমি প্রথম আলোর সঙ্গে যুক্ত হই। প্রথম আলো সহযোগিতায় আমি কলেজ ও স্নাতক পর্যায়ে পড়াশোনা করি।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

স্নাতক আপনার শেষ হলো কবে? আপনি কোন বিষয় নিয়ে স্নাতক শেষ করলেন?

মাসুবা আক্তার আশা: আমি গোপালগঞ্জের সরকারি কলেজ থেকে স্নাতক শেষ করেছি ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়ে। আমি কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছিলাম। কিন্তু আমার মায়ের যেহেতু আর কেউ নেই, তাই আমারে দূরে যেতে দিলেন না মা।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

আচ্ছা। স্নাতক পড়ার সময় থেকেই কি আপনি ফ্রিল্যান্সিংয়ের সঙ্গে যুক্ত হলেন নাকি স্নাতক শেষ হওয়ার পরে যুক্ত হলেন?

মাসুবা আক্তার আশা: স্নাতক শেষ হওয়ার পরে যুক্ত হয়েছি।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

ফ্রিল্যান্সিং করবার সাহসটা পেলেন কিভাবে? মানে এই ধৈর্যটা ধরবার সাহসটা পেলেন কি করে?

মাসুবা আক্তার আশা: আসলে এটা সম্পূর্ণ ক্রেডিট আমার আম্মুর। এই সাহসটা আমার আম্মুই যোগাইছে। প্রথম আলো আমাকে উপবৃত্তি দিল। উপবৃত্তির টাকা কোনো দিন ওড়াইনি। আমি টাকা গুছিয়ে রেখেছি। আমার আম্মুও কষ্ট করে কিছু গুছাইছে। আর আমিও এখান থেকে বই খাতা ও যাবতীয় জিনিস কেনার পর কিছু টাকা জমা করেছি। আমার ও আম্মুর জমানো টাকা দিয়ে আমাকে একটা কম্পিউটার কিনে দেয়। তারপর থেকে একটু একটু করে কাজ শুরু করি।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

আপনি নিজেকে একজন সফল ফ্রিল্যান্সার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চান। আমাদের শুভকামনা তো অবশ্যই থাকবে। এই যে মায়ের সাহসে ফ্রিল্যান্সিংয়ে গেলেন। মা এখন কি বলেন?

মাসুবা আক্তার আশা: মা খুবই খুশি হয়েছেন। আমি ২০১৯ থেকে শুরু করে ২০২০ সালে ফ্রিল্যান্সিং শেখা শুরু করি। প্রায় দেড় বছর কাজ শিখেছি। অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করতাম, অনেক সময় সকাল হয়ে যেত। কারণ বায়ার গ্রুপদের বাংলাদেশ টাইমে রাতে পাওয়া যায়। সন্ধ্যা থেকে শুরু করে নামাজ, খাওয়া বাদে বাকি সময় কম্পিউটারে বসে থাকতাম। কিন্তু আমি যখন কাজ পেতে শুরু করি, টাকা পেতে শুরু করলাম, তখন আমার আম্মু মারা যায়। ২০২৪ এর আগস্ট মাসে আমাকে একা করে মা চলে যান। এরপর আমি কাজ করা বন্ধ করে দিই। আমার কোনো কিছু ভালো লাগত না, আমি খাইতে-ঘুমাতে পারতাম না। আমার এত বছরেও ফসল ডাউন হয়ে যায়। প্রায় মাস দেড়েক আগে হঠাৎ করে সন্ধ্যার সময় বসে কাজ করছি। মাঝে মাঝে অ্যাকাউন্টে ঢুকি। সপ্তাহ একদিন কিংবা ১০ দিন পরে একটা ডিজাইন করি, জমা দেই। হঠাৎ দেখি আমার একটা ডিজাইন অনেক হাই রেটেট হয়ে গেছে। অনেক অনুসারী বেড়ে গেছে।

তারপরে আমার একটা কুকিং চ্যানেল আছে, সেটাও প্রচুর পরিমাণের অনুসারী আসা শুরু হলো। তখন আমি ওখান থেকে আবার কাজ শুরু করলাম। কুকিং চ্যানেলও হাই হচ্ছে। তারপর বায়ার আসছে। আসলে ফ্রিল্যান্সিং হচ্ছে সরকারি চাকরিতে যেমন টাকা ফিক্সড থাকে এটা আবার ফিক্সড নয়। দেখা যাচ্ছে কোন মাসে ইনকাম হচ্ছে আবার কোন মাসে ইনকাম হচ্ছে না। আমি অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ওদিকের কিছু বায়ারের কাজ করছি। কারণ ওরা কথা দিয়ে কথা রাখে। আর আমি লিংকডিন প্রফেশনাল মোডে আছে আমার। এ জন্য যেকেউ আমাকে টাকা দিত ভরসা পাবে। আর কুকিং চ্যানেলে আল্লাহর রহমতে আমি ঈদের দুদিন আগে কনটেন্ট মনিটাইজেশন পেয়েছি। ওখান থেকে আমার আয় আসছে। ওই চ্যানেলটাও আমার আম্মুর তৈরি করা। কারণ ওখানে কণ্ঠ আমি দিয়েছি কিন্তু রান্না আমার আম্মু করেছে। এখন ওইটা আমি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

আপনি অনেক চড়াই-ওতরাই পেরিয়ে আজকে এখানে এসেছেন। বাবাকে আপনি পাননি। আপনার জন্মের আগে বাবা মারা যান এবং আপনার মা অনেক কষ্ট করে আপনাকে বড় করেন। তারপর মাও চলে গেলেন। বিশেষ করে খারাপ সময়গুলোতে আমরা সাহস হারিয়ে ফেলি। আপনি কিভাবে ঘুরে দাঁড়ালেন এবং এখন আমাদের যারা অদম্য মেধাবী আছেন তাদের উদ্দেশ্যে আপনার কোনো পরামর্শ আছে?

মাসুবা আক্তার আশা: আসলে আমিও খুব ভেঙে পড়েছিলাম। এখনো আমার মানসিক অবস্থা খারাপ। তারপরও চেষ্টা করছি। জীবনে বেঁচে থাকতে হলে, সফল হতে হলে ধৈর্যসহকারে কাজ করে যেতে হবে। আমার আম্মুর চেষ্টা আর প্রথম আলোর সহযোগিতায় আজকে আমি এ পর্যন্ত এসেছি। আসলে নিজের ইচ্ছা পূরণ করতে হলে ধৈর্য সহকারে কাজ করতে হবে। ধৈর্য হারা হলে চলবে না।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনি আপনার পুরোটা জীবনে যেরকম সাহস ধরে রেখেছেন, নিজের ওপর ভরসা করেছেন, সেরকম ভরসা রেখে সামনের দিনগুলিতে এগিয়ে যাবেন। আমাদের এই দোয়াই থাকবে আপনার জন্য। আপনি ফ্রিল্যান্সার হিসেবে সত্যি সত্যি সফল হন এবং আপনার চেষ্টা এই আকাঙ্ক্ষা এই স্বপ্নটা অব্যাহত থাকুক এবং স্বপ্নটা সত্যি হোক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

মাসুবা আক্তার আশা: আপনাদেরও ধন্যবাদ আমার পাশে দাঁড়ানোর জন্য, আমাকে সহযোগিতা করার জন্য।