লাবনীর অপেক্ষা, কবে বলবেন— ‘মা, তোমাকে আর কাজে যেতে হবে না’
প্রথম আলো ট্রাস্টের নিয়মিত আয়োজন ‘অদম্য মেধাবীর সঙ্গে’ অনুষ্ঠানের এ পর্বের অতিথি ছিলেন ‘ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী তহবিল’ থেকে শিক্ষাবৃত্তি পাওয়া মোংলার মেয়ে লাবনী আক্তার। তিনি সম্প্রতি গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ নার্সিং কলেজ থেকে বিএসসি ইন নার্সিং শেষ করে ইন্টার্নশিপ করছেন। পাশাপাশি চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও তাঁর এগিয়ে চলার গল্পগুলো শেয়ার করলেন ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বিকেল ৫টায় প্রথম আলো ট্রাস্টের অনলাইন আয়োজনে।
লাবনীর বাবা লুৎফর রহমান শিপে মালামাল ওঠা-নামার কাজ দেখাশোনা করতেন। এতে করে ভালোই চলছিল সংসার। কিন্তু ২০০১ সালে হঠাৎ তিনি মারা যান। তখন লাবণীর বয়স ১১ মাস, বড় বোন শিল্পীর বয়স দুই বছর, বড় ভাই ৮-১০ বছর হবে। এমন অবস্থায় মা বেবী বেগম তিন সন্তানকে নিয়ে অকূলপাথারে পড়লেন। সন্তানের খাওয়া-পড়ার খরচ পাবেন কোথায়? নিজেদের কোনো জমি-জিরাত নেই। ছোট্ট যে ঘরটাতে ভাড়া থাকেন, তার ভাড়া দেবেন কীভাবে? বেবী বেগম কখনো দিনমজুর, কখনো হোটেলে ধোয়ামোছার কাজ করলেন। ভোর থেকে রাত অবধি হাড়ভাঙা খাটুনি। সন্তানদের প্রতি তাঁর একটাই কথা ছিল—ঠিকমতো পড়াশোনা করতে হবে। মাকে দেওয়া কথা রাখল লাবনী। এসএসসি পরীক্ষায় মোংলার টিএ ফারুক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পান তিনি। বোন শিল্পী আক্তারও একই স্কুলের মানবিক বিভাগ থেকে পাস করেন। ভালো ফল ও পারিবারিক অবস্থা বিবেচনায় লাবনীর পাশে দাঁড়ায় ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী তহবিল। তাঁকে দেওয়া হয় শিক্ষাবৃত্তি।
অনুষ্ঠানে লাবনী জানালেন, ‘বাবা মারা গেলে মা বিপদের মধ্য পড়ে যান। আমাদের খাওয়া পড়া জোটাতে হিমশিম খেতে হয়। মা নিরক্ষর ছিলেন। তখন ছোট ছোট বিভিন্ন ধরনের কাজ করেছেন। যেমন ভাটায় শ্রমিকদের রান্না করতেন। এদিকে আমি ভালো ছাত্রী ছিলাম বলে শিক্ষকেরা সাপোর্ট করতেন। পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পাওয়ার পর শিক্ষকেরা আরও মনোযোগী হন, আমাকে বইপত্র দিতেন। এভাবে এসএসসি পরীক্ষা দিই। ওই সময় আমার বড় ভাই মারা যান। ছেলে হারিয়ে মা আরও ভেঙে পড়নে। যা হোক, আমি জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হই। প্রথম আলো মোংলা প্রতিনিধি আমাকে নিয়ে নিউজ করেন, প্রতিবেদন ছাপা হয়। পরে প্রথম আলো ট্রাস্ট আমার পাশে দাঁড়ায়। তাদের সহায়তায় পড়াশোনা করতে থাকি। কিন্তু ওই সময়টাতে পরিবারের অবস্থা এত খারাপ ছিল যে, আমাকে টিউশনির দিকে যেতে হয়, পরিবারকে কিছুটা সাপোর্ট করার জন্য। ফলে এইচএসসিতে ফল কিছুটা খারাপ হয়। তারপরও মেডিকেলে পরীক্ষা দিই, হয়নি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সুযোগ পাই, তবে ভালো বিষয় পাইনি। পরে অনেকের সঙ্গে কথা বলে নার্সিংয়ে পরীক্ষা দিয়ে সরকারি বিএসসি নার্সিংয়ে সুযোগ হয়। এভাবে নার্সিংয়ে পড়া শুরু করি। এ সময় মা অনেক সাপোর্ট করেছে। এখনো তিনি কাজ করেন আমাদের জন্য।’
এত কষ্টের মধ্যেও লাবনী শুধু পড়াশোনা নিয়েই থাকেননি। সামাজিক নানা কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। প্রথম আলো বন্ধসভায় যোগ দেন। নার্সিং কলেজে পড়ার সময়ও এক্সট্রা কারিকুলার কাজের সঙ্গে যুক্ত হন। অ্যাঙ্করিং, ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাবে যুক্ত ছিলেন। এই কাজগুলো তাঁর কনফিডেন্স লেবেল বাড়াতে সাহায্য করেছে। ভবিষ্যতে শিশুদের নিয়ে এবং বৃদ্ধ নিবাসে কাজ করার আগ্রহ আছে জানালেন।
মায়ের অনুভূতি কেমন জানতে চাইলে লাবনী জানান, ‘মা অনেক খুশি, আমাকে নিয়ে গর্ব করেন। মা এলাকার মানুষের সঙ্গে অনেক আলাপ করেন আমাদের নিয়ে। মা যে কষ্ট করেছেন তাঁর ফল দিতে পারব শীঘ্রই। মায়ের স্বপ্নপূরণের কাছাকাছি আছি। সেই দিনের আশায় আছি, যেদিন বলতে পারব—মা তোমাকে আর কাজ করতে হবে না।’
এরপরের স্বপ্নটা কি? লাবনী বললেন, ‘ইন্টার্নশিপ শেষ করে স্নাতকোত্তর করব। শিক্ষকতা যাওয়া ইচ্ছা আছে। পাশাপাশি বিসিএস দেব। প্রস্তুতি চলছে।’
এখন যারা অদম্য মেধাবীরা আছে তাদের জন্য লাবনীর পরামর্শ হলো, ‘প্রতিকূলতা পদে পদে থাকে। তবে মনোবল শক্ত থাকলে সব প্রতিকূলতাই কাটানো সম্ভব। আমি যেমনটা পেরেছি। তবে আমার মা ছিল আমার শক্তি। তিনি অনেক সাপোর্ট দেন। আমাকে বিয়ে দিতে চেয়েছে অনেকে। কিন্তু মা কর্ণপাত করেননি। এখনো কঠোর পরিশ্রম করে চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি। দিনে শেষে পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে মানসিকতা থাকতে হবে। বাধা যেমন আছে, উপায়ও আছে।’
প্রথম আলো ট্রাস্টের নিয়মিত আয়োজন ‘অদম্য মেধাবীর সঙ্গে’ অনলাইন এই অনুষ্ঠানটি একযোগে প্রচার করা হয় প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ইউটিউব চ্যানেল এবং প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ফেসবুক পেজ থেকে। সঞ্চালনায় ছিলেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা।