সুরাইয়া হুদার জন্ম অসচ্ছ্বল পরিবারে। ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’– মাত্র পাঁচ বছর বয়সে পোলিওতে অচল হয় তাঁর ডান পা। অচল পা নিয়েই স্কুলে ভর্তি হলেন ঠিকই, কিন্তু বাড়ি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে স্কুল। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে হেঁটেই স্কুলে যেতেন সুরাইয়া। কখনো কখনো বন্ধুদের কাঁধে ভর দিয়ে একটু সাহায্য নিতেন।
প্রাথমিকের পালা শেষ করে আকিজ কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হলেন। কিন্তু সেই এতটুকুন বয়সে যাঁর জীবনের যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, জীবনে পদে পদে যেন পরীক্ষাই লিখে রেখেছিলেন বিধাতা। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় আকস্মিক স্ট্রোকে বাবাকে হারালেন। অসচ্ছল পরিবারে শুরু হলো অভাবের আনাগোনা। ফল ভালো করতেন বলে শিক্ষকেরা বরাবরই স্নেহ করতেন। সে সময় স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা বেতন মওকুফ করে দিয়ে পড়াশোনায় সহযোগিতা করেন।
এই যে এত কষ্ট করে পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন সুরাইয়া, তাঁর ফল পেয়েছেন হাতে নাতে। ২০১২ সালে জিপিএ–৫ পেয়ে এসএসসি পাস করেন। উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে প্রথম আলো ট্রাস্টের অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তি পান। বৃত্তির টাকা দিয়ে সুরাইয়া পড়াশোনার খরচ চালিয়েছেন, আবার সংসারে সাহায্য করেছেন। পড়াশোনায় সাফল্যের ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছিলেন হার না–মানা অদম্য মেয়েটি। এইচএসসিতেও পান জিপিএ–৫ ।
উচ্চশিক্ষার পথে পা বাড়ালেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবন্ধী কোটায় এবং কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাতালিকায় সুযোগ পেলেন। সুরাইয়া সিদ্ধান্ত নিলেন নিজের মেধাকেই মূল্যায়ন করবেন। ভর্তি হলেন কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁর ধারাবাহিক সাফল্যের জন্য স্নাতক পর্যায়েও ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী তহবিলের শিক্ষাবৃত্তি পান। বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় সহপাঠীদের সঙ্গে মিলে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেন। অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য যে পরীক্ষায় তিনি বসেছিলেন, সে পরীক্ষায়ও নির্বাচিত হয়ে ভাইভার সুযোগ পেয়ে যান।
সুরাইয়ার জীবনের সবচেয়ে বড় যুদ্ধটা বোধ করি তখন থেকেই শুরু। সুরাইয়াকে এবার সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তিনি চাকরি করবেন, না পড়াশোনা চালিয়ে যাবেন। সুরাইয়া সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি চাকরিও করবেন, সঙ্গে পড়াশোনাও শেষ করবেন। তাঁর কর্মস্থলে সপ্তাহে ছয় দিন ক্লাস নিতেন। বৃহস্পতিবার ক্লাস শেষ করে যেতেন কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে সহপাঠীদের কাছ থেকে সারা সপ্তাহের পড়াশোনা বুঝে নিতে। নিয়মিত ক্লাস করতে পারতেন না বলে হলের সিটটা কিছুদিনের মধ্যেই বাতিল হয়ে যায়। সহপাঠীদের কাছ থেকে নোট সংগ্রহ করে শুক্রবার সন্ধ্যায় আবার ফিরতেন যশোরে। সেই দ্বিতীয় বর্ষের পর থেকে এভাবেই কখনো লোকাল বাসে ক্রাচ হাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে যশোর থেকে কুষ্টিয়া যাতায়াত করেছেন। পরীক্ষার সময় সকালবেলা যশোর থেকে কুষ্টিয়া গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে ফিরে আসতেন। এভাবেই বিবিএ আর এমবিএ সম্পন্ন করেন সুরাইয়া।
অদম্য মেধাবীদের জন্য আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে একবার সুরাইয়া বলেছিলেন, তিনি ব্যাংকে চাকরি করবেন। কিন্তু এখন যখন সুরাইয়ার কাছে জানতে চাওয়া হয়, কী হতে চান তিনি, একগাল হেসে বলেন, ‘আমি শিক্ষকতাই করব। আমার ছাত্রছাত্রীরা, সহকর্মীরা আমাকে এত ভালোবাসা দিয়েছেন, তাঁদের ছেড়ে এখন আমি কোথাও যেতে চাই না। আমি তাঁদের আমার জীবনযুদ্ধের গল্প বলি। তাঁদের নিয়ে স্বপ্ন দেখি। হয়তো আমার মতো কেউ ওঁদের মধ্যে আছে। তাঁদের বিকাশের দায়িত্ব আমার। এটাই আমার স্বপ্ন।’
সুরাইয়া আরও বলেন, ‘আমি যদি শারীরিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে চাকরি আর পড়াশোনা একসঙ্গে চালিয়ে যেতে পারি, তাহলে এখন যারা অদম্য মেধাবী আছে, তারাও পারবে। কখনো ভাবা যাবে না, যে আমি পারব না। চেষ্টা করলে পারা যাবে না, পৃথিবীতে এমন কোনো কাজ নেই। ইচ্ছাশক্তি থাকলে সব সম্ভব। মানসিক শক্তি ধরে রাখতে পারলে কোনো বাধাই বাধা নয়। আর আমাদের পাশে প্রথম আলো ট্রাস্ট তো আছেই।’
অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তি সম্পর্কে সুরাইয়া বলেন, ‘যখন আমি অদম্য শিক্ষাবৃত্তি পেয়েছি, তখন আমার মনে হলো, আমি যেন আমার বাবাকে কিছুটা ফিরে পেয়েছি। বাবা যেমন দায়িত্ব নিয়ে সন্তানের পড়াশোনা করান, আমি তেমন একটা আলোর পথ খুঁজে পেলাম। তখন থেকে আমি ট্রাস্টের শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা করেছি।’
সুরাইয়া এরই মধ্যে বিয়ে করেছেন। কোল আলো করে ঘরে এসেছে কন্যা সন্তান। নাম তাঁর জারা। ঘরে–বাইরে এখন আরও ব্যাস্ত সময় কাটছে তাঁর। শিক্ষার আলো বিতরণ পাশাপাশি ছোট্ট জারার সঙ্গে খুনসুটি এই নিয়ে দারুণ সুখে দিন কাটছে সুরাইয়ার।