শেকড় থেকে শিখরে

স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় কৃতিত্বপুর্ণ ফলাফলের জন্য চন্দ্র শেখর চৌহান প্রেসিডেন্ট গোল্ড মেডেল অর্জন করেন।

চন্দ্র শেখর চৌহান কোনো গল্পের নায়ক নন। তিনি প্রথম আলোর অদম্য মেধাবী। সাধনা আর পরিশ্রম করলে সবই অর্জন করা যায়, তার প্রমাণ দেখিয়েছেন চন্দ্র শেখর।

গাইবান্ধা জেলা শহরের শণিমন্দির রোডে চন্দ্র শেখরদের বাড়ি। বাবা মানিক চৌহানের (৫২) নিজস্ব কোন সহায়-সম্পদ নেই। একই রোডের শণিমন্দিরের পাশে চারশতক অন্যের জায়গায় বসবাস। বাড়ির কাছেই শণিমন্দির রোড ঘেঁষে ফুটপাতে তাঁর চায়ের দোকান। দোকানে চা, পরোটা, পেয়াজু, সিঙ্গারা বিক্রি করেন। ঘরের মেঝেতে মা মিনা চৌহান (৪৭) কাগজ দিয়ে ঠোঙ্গা বানান। সেই ঠোঙ্গা দোকানে বিক্রি করেন। মানিক চৌহানের দুই ছেলে। বড়ছেলে চন্দ্র শেখর। ছোটছেলে সৌরভ চৌহান।

চন্দ্র শেখর চৌহান ২০০৫ সালে গাইবান্ধা ল’ কলেজ কিন্ডার গার্টেন থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করেন। এরপর গাইবান্ধা সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। এ বিদ্যালয় থেকে ২০১০ সালে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পান। ২০১৩ সালে গাইবান্ধা সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসিতেও জিপিএ-৫ অর্জন করেন চন্দ্র শেখর। এরপর ময়মনসিংহস্থ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভেটেনারি বিভাগে ভর্তি হন। ২০২০ সালে এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেডিসিন বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতকোত্তর পাস করেন।শুধু তাই নয়, স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় কৃতিত্বপুর্ণ ফলাফলের জন্য তিনি প্রেসিডেন্ট গোল্ড মেডেল অর্জন করেন।

চন্দ্র শেখর ২০২২ সালের ৩০ জুলাই বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিসিন বিভাগে শিক্ষক হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন। এসএসসি পাসের পর থেকে অদম্য মেধাবী হিসেবে তাঁকে প্রথম আলো ট্রাষ্ট্রের বৃত্তির আওতায় নেওয়া হয়। এরপর দীর্ঘ সাতবছর তাঁকে বৃত্তি দেয় প্রথম আলো। চন্দ্র শেখর চৌহান বলেন, প্রথম আলো আমাকে সাতবছর বৃত্তি দিয়েছেন। তিনি প্রথম আলোকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, পত্রিকাটি আমাকে সহায়তা ও অনুপ্রেরণা দিয়ে সাহস জুগিয়েছে। যে কারণে এ অর্জন সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে সবসময় পরিশ্রম করতে হবে। পরিশ্রমের বিকল্প কিছুই নেই। আমি পরিশ্রম না করলে এ জায়গায় আসতে পারতাম না। পরিশ্রমের কারণে রেজাল্ট ভালো হয়েছে, পরবর্তীতে শিক্ষকতা পেলাম। পারিবারিক অস্বচ্ছলতা কোন বড় বাধাই নয়। মানুষের ইচ্ছে থাকলে যেকেউ ভালো করবেই। দেশকে ভালোবাসতে হবে। দেশের মানুষের কথা চিন্তা করতে হবে। তিনি বলেন, যেহেতু প্রথম আলো ট্রাষ্ট আমার পাশে ছিল, তাই আমি আজীবন প্রথম আলো ট্রাষ্টের সাথেই থাকতে চাই। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগে একজনকে পড়াশোনার জন্য সহায়তা করছি। ভবিষ্যতে আরও চেষ্টা থাকবে।

মানিক চৌহানের বড়ছেলের পথেই হাটছে ছোটছেলে সৌরভ চৌহান। তিনি গাইবান্ধা সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১৬ সালে এসএসসি এবং ঢাকা নটরডেম কলেজ থেকে ২০১৮ সালে এইচএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়েছেন। তাঁকেও অদম্য হিসেবে প্রথম আলো বৃত্তি দিচ্ছে। ২০২০ সালে সৌরভ চৌহান বাংলাদেশ টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুটেক্স) ভর্তি হন। তিনি ইয়াং (তুলা ও পাট থেকে সুতা তৈরি) বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছেন।

চন্দ্র শেখরের বাবা মানিক চৌহান বলেন, আমার দুই ছেলের পাশে যারা ছিলেন, তাদেরকে আমার ছেলেরা যেন মনে রাখে, বাবা হয়ে সেটাই আমার চাওয়া। এ ছাড়া ছাত্রজীবনে তারা যেভাবে সহায়তা পেয়েছে, প্রতিষ্ঠিত হবার পর অন্য শিক্ষার্থীদের জন্য যেন ছেলেরা সেভাবেই সহায়তা করে। মা মিনা চৌহান বলেন, দুই ছেলের জন্য আমি গর্বিত। আমরা জীবনে যেভাবে কষ্ট করছি, ছেলেরা প্রতিষ্ঠিত হয়ে শুধু বাবা-মার কষ্ট দুর করবে, সেটা আমরা চাই না। তারা দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করবে, সেটাই আমরা ছেলেদের কাছে চাই।