পরিবারের হাল ধরে সমাজকে আলোকিত করতে চায় তারা 

অভাব জয় করে এগিয়ে চলছে তারা। সামনে লক্ষ্য পরিবারের হাল ধরার পাশাপাশি সমাজকে আলোকিত করা।

অভাব–অনটন আর পারিবারিক উত্থান–পতনের মাঝেই এগিয়ে গেছে তারা। কেউ সেলাই মেশিনে বসে, কেউ টিউশনি করে, কেউ আবার বাবাহীন সংসারের ভার সামলে পড়াশোনা চালিয়েছে। ভাঙনে ভিটেমাটি হারানো, ভ্যানচালক বাবার সীমিত আয় কিংবা ছোট্ট মুদিদোকানের টানাপোড়েন—এসব বাধা তাদের পথ আটকে রাখতে পারেনি।

সংগ্রামকে সঙ্গী করেই এবারের এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ–৫ পেয়েছে গাইবান্ধার রিয়ানা আস্তিক, পঞ্চগড়ের রুপসানা আক্তার, নাটোরের মৃত্তিকা সুলতানা ও ফরিদপুরের নন্দিতা বিশ্বাস। দারিদ্র্যের কঠিন বাস্তবতা সত্ত্বেও চারজনের চোখে এখন একটাই লক্ষ্য—শিক্ষার আলোয় নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়া এবং পরিবারকে এগিয়ে নেওয়া।

সেলাইয়ের টাকায় পড়াশোনা

গাইবান্ধার ব্রহ্মপুত্রপারের এক ছোট্ট গ্রাম বাটকামারিতে ছিল রিয়ানা আস্তিকের বাড়ি। জমি–বাড়ি, ফসল—সব মিলিয়ে ছিল সচ্ছল সংসার। কিন্তু ছয় বছর আগে নদীভাঙনে সব হারায় তারা। ভিটেমাটি বিলীন হয়ে যাওয়ার পর তিন বোন আর মা–বাবাকে নিয়ে আশ্রয় নিতে হয় নানার বাড়ি, সদর উপজেলার মধ্য ফলিয়া গ্রামে। সেখানেই নতুন করে শুরু হয় রিয়ানাদের সংগ্রামের গল্প।

সংসারের অভাব কাটাতে পড়াশোনার পাশাপাশি রিয়ানা সেলাই মেশিনে বসে। ভোর–সকাল কিংবা রাত—সময় পেলেই অন্যের জামা সেলাই করে। সেই আয় দিয়েই চালায় নিজের পড়াশোনার খরচ, পরিবারেও সহযোগিতা করে। তবু থামেনি স্বপ্নের পথে। এবারের এসএসসি পরীক্ষায় গাইবান্ধা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ–৫ পেয়েছে সে। রিয়ানা আস্তিক জানায়, লেখাপড়া করে প্রকৌশলী হতে চায় সে। সংসারের হাল ধরে মা–বাবার অভাব ঘোচাতে চায়।

চার বোনের মধ্যে রিয়ানা দ্বিতীয়। বড় বোন এইচএসসি পরীক্ষার্থী, ছোট দুই বোন প্রাথমিক স্তরে পড়ছে। বাবা রফিকুল ইসলাম গৃহশিক্ষক, মা গৃহিণী। সংসারের সীমিত আয়ে পড়াশোনার খরচ জোগানো কঠিন হলেও মেয়ের স্বপ্নে ভরসা রাখেন তাঁরা। মা মেরিনা সুলতানা জানান, ভাঙনের পর আশ্রয়ের জায়গা হলেও মেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। আত্মীয়স্বজনের কাছে তো লেখাপড়ার খরচ চাওয়া যায় না। তাই মেয়ের সেলাইয়ের কাজে সহায়তা করছেন। রিয়ানার বাবা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘মেয়েটা বড় ক্লাসে উঠবে, পড়াশোনার খরচ বাড়বে। মেয়ের লেখাপড়া নিয়ে চিন্তায় আছি।’

রিয়ানার স্কুলের শিক্ষক সাদাত রিয়াদ বলেন, অভাবের মধ্যেও রিয়ানা পড়াশোনায় মনোযোগী ছিল। বিদ্যালয় থেকে তাকে সহায়তা দেওয়া হয়েছে।

‘বাবা থাকলে অনেক খুশি হতেন’

‘সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় বাবা মারা গেছেন। তখন থেকে মা অনেক কষ্ট করে আমাদের পড়াশোনার খরচসহ সংসার চালাচ্ছেন। এবার যখন জিপিএ-৫ পেলাম, তখন মা খুব খুশি হয়েছেন। বাবা থাকলে তিনিও অনেক খুশি হতেন। পড়াশোনা করে ভালো মানুষ হতে চাই।’

কথাগুলো বলছিল রুপসানা আক্তার। সে এবার পঞ্চগড় সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে। তাদের বাড়ি পঞ্চগড় সদর উপজেলার হাফিজাবাদ ইউনিয়নের আমকাঁঠাল বাজারে।

পরিবারের সদস্যরা জানান, রুপসানার বাবা আমিরুল ইসলামের মৃত্যুর পর চার মেয়েকে নিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েন তাদের মা আনছিনা আক্তার। ভিটেবাড়ির ছয় শতক জমি ছাড়া আর কোনো আবাদি জমি নেই তাদের। স্বামীর রেখে যাওয়া বাড়িসংলগ্ন ছোট্ট মুদিদোকান চালিয়ে খেয়ে না খেয়ে পড়াশোনা করাচ্ছেন মেয়েদের। চার বোনের মধ্যে রুপসানা দ্বিতীয়। বড় বোনের বিয়ে হয়েছে। এ ছাড়া ছোট দুটি বোন পড়াশোনা করছে মাদ্রাসা ও স্কুলে।

আনছিনা আক্তার বলেন, ‘মেয়েটা আমার অনেক মেধাবী। সে সৈয়দপুর সরকারি বিজ্ঞান কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। আত্মীয়স্বজনের সহায়তায় কলেজে ভর্তির জন্য কিছু টাকা জোগাড় করেছি। কিন্তু এরপর ওর পড়াশোনার খরচ কীভাবে জোগাড় করব, সেই দুশ্চিন্তায় পড়েছি।’

বোনদের মতো ঝরে পড়তে চায় না মৃত্তিকা

প্যাডেলভ্যান চালিয়ে চলে মোহম্মদ আলীর সংসারের চাকা। হাঁটুর ব্যথায় মাঝেমধ্যেই থেমে যায় চাকা। তবু দুই মেয়েকে এসএসসি পাস করিয়ে বিয়ে দিয়েছেন। তাঁর তিন সন্তানের অপরজন মৃত্তিকা সুলতানা। এবার জিপিএ-৫ পেয়ে মানবিকে এসএসসি পাস করেছে। তার সংকল্প, অন্য বোনদের মতো সে এখনই বিয়ে করবে না। শতকষ্ট করে হলেও উচ্চশিক্ষা অর্জন করে বিচারক হবে।

নাটোর সদর উপজেলার ছাতনী ইউনিয়নের ভাটপাড়া গ্রামের ভ্যানচালক মোহাম্মদ আলীর বাড়ির ভিটে ছাড়া অন্য কোনো জমি নেই। প্যাডেলভ্যান চালিয়ে ও দিনমজুরি করে সংসার চলে। বড় মেয়ে মৌমিতা এসএসসি পাস করলে আর্থিক অনটনের কারণে তাঁকে কলেজে ভর্তি করাতে পারেননি। নিরুপায় হয়ে বিয়ে দিয়েছেন। মেজ মেয়ে মিথিলা পরের বছর এসএসসি পাস করেন। তিনি উচ্চশিক্ষিত হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাবা তাঁর ইচ্ছা পূরণ করতে পারেননি। এসএসসির পর তাঁরও বিয়ে হয়ে যায়। 

এবার সদর উপজেলার ছাতনী উচ্চবিদ্যালয় থেকে মানবিকে জিপিএ-৫ পেয়েছে মৃত্তিকা। সে বলে, মা–বাবাকে অনুরোধ জানিয়েছে, তার যেন বিয়ে ঠিক করা না হয়। সে যে করেই হোক লেখাপড়া শেষ করে বিচারক হবে। অসহায় মানুষকে ন্যায়বিচার দেবে।

মৃত্তিকার বাবা মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘বাড়ির জায়গাটুকু ছাড়া আমার সম্পদ বলতে কিছুই নেই। ভ্যান চালায়ে খাই। এসবের জন্য আগের দুই মেয়েকে বেশি পড়াতে পারিনি। এখন মৃত্তিকা জেদ ধরিছে সে অনেক পড়ালেখা করবে। জজ হবে। আমি কি ওর সাধ পূরণ করতে পারব, এটাই ভাবছি।’

বিদ্যালয়ে একমাত্র জিপিএ–৫ নন্দিতার

ফরিদপুর সদরের কোমরপুর আবদুল আজিজ ইনস্টিটিউট থেকে এ বছর মাত্র একজন শিক্ষার্থী জিপিএ–৫ পেয়েছে। তার নাম নন্দিতা বিশ্বাস। মানবিক বিভাগ থেকে এই কৃতিত্ব দেখিয়েছে সে। এরপর অর্থাভাবে তার পড়াশোনা চালানো নিয়ে চিন্তায় পড়েছে পরিবার।

নন্দিতা সদর উপজেলার বাহিরদিয়া গ্রামের নিমাই চন্দ্র বিশ্বাস ও অঞ্জলি বিশ্বাসের মেয়ে। তিন বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে সে মেজ। বাবা ছোট্ট একটি মুদির দোকান চালান, তা দিয়েই চলে সংসার। তাই নিজের পড়াশোনার খরচ চালাতে নন্দিতা দুই জায়গায় টিউশনি করে।

নন্দিতার মা অঞ্জলি বিশ্বাস বলেন, ‘নন্দিতা ভালো রেজাল্ট করেছে, এ জন্য আমাদের আনন্দের সীমা নেই। ও শুধু পরিবার নয়, মহল্লা নয়, সর্বোপরি স্কুলের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু আনন্দের পাশাপাশি আমাদের মনের কোনায় উঁকি দিচ্ছে শঙ্কা। দিনে দিনে খরচ বাড়ছে। মুদির দোকানের বিক্রি একটা জায়গায় আটকে আছে। এভাবে কীভাবে চলবে সামনের দিনগুলো। প্রতিদিন কলেজ করলেও তো অন্তত ১০০ টাকা খরচ হবে ওর পেছনে। ওকে নিয়ে কত দূর যেতে পারব বুঝতে পারছি না।’

ভালো ফল করে নন্দিতা এখন ফরিদপুর সরকারি সারদা সুন্দরী মহিলা কলেজে ভর্তি হতে চায়। তার স্বপ্ন শিক্ষক হওয়া। সে বলে, ‘একজন ভালো শিক্ষক কীভাবে শিক্ষার্থীর জীবন বদলে দিতে পারেন, আমি তা দেখেছি। তাই শিক্ষকতাকেই জীবনের লক্ষ্য করেছি।’

স্কুলের প্রধান শিক্ষক গোপাল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘নন্দিতা আমাদের অহংকার। তার নিষ্ঠা ও পরিশ্রম স্বপ্নপূরণের পথ খুলে দেবে। তবে দারিদ্র্যই তার বড় বাধা।’

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, ফরিদপুর, প্রতিনিধি, গাইবান্ধা, নাটোর পঞ্চগড়]