নীলফামারীর ডোমার উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম বড় দলুয়া। এই গ্রামের ছেলে প্রশান্ত রায়। ছোট থেকেই পড়াশোনায় তাঁর প্রবল আগ্রহ। কিন্তু বাদ সাধে পরিবারের অসচ্ছলতা। বাবা দিনমজুরি করে সংসার চালাতেন। বাবা ছেলের বায়না পূরণ করতে পারবেন না জেনে লেখাপড়ার খরচের বাইরে অন্য কোনো বিষয়ে চাওয়া-পাওয়া ছিল না প্রশান্তের। উল্টো টিউশনি করে এবং বাবার সঙ্গে জমিতে কাজ করে লেখাপড়া চালিয়ে গেছেন তিনি। এমন পরিশ্রমের ফলও পেয়েছেন। এত অনটনের মধ্যেও ২০১২ সালে তিনি পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার সোনাহার দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন। কিন্তু পরিবারে আনন্দ ছিল না। কলেজ ভর্তি হতে পারবেন কিনা—এমন দুশ্চিন্তায় ছিলেন প্রশান্ত। তখন প্রথম আলোর প্রতিনিধি তাঁকে নিয়ে প্রতিবেদন করলেন প্রথম আলোয়। তাঁকে দেওয়া হলো ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তি।
বৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা করে ২০১৪ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। পুনরায় শিক্ষাবৃত্তি অব্যাহত রাখা হয় তাঁর। ভালো করে পড়াশোনা করে ২০১৩-১৪ সেশনে হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে ভর্তি হন। এখান থেকেই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্ব শেষ করেছেন। বর্তমানে তিনি নিজ উপজেলার বড়গাছা ডাঙ্গাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত।
প্রথম আলো ট্রাস্টের নিয়মিত অনলাইন আয়োজন 'অদম্য মেধাবীর সঙ্গে’ অনুষ্ঠানের অতিথি ছিলেন প্রশান্ত রায়। গত ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, সোমবার, বিকেল ৫টায় প্রথম আলো ট্রাস্টের এ অনুষ্ঠানে তাঁর সফল হওয়ার পেছনের গল্প ওঠে আসে।
অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রশান্ত রায় বলেন, ‘প্রথমেই কৃতজ্ঞতা জানাই সৃষ্টিকর্তার প্রতি। এরপর পিতামাতা ও ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্টের প্রতি আমার পাশে দাঁড়ানোর জন্য। জীবনের চলার পথ কঠিন ছিল। ছোটবেলা থেকে নিভৃতপল্লীতে থেকে অনেকে কষ্ট করেছি। কারণ আমি আমার এলাকার প্রথম স্নাতক। আমি যখন পড়াশোনা করেছি, তখন পড়াশোনার চর্চা ছিল না। এখন অনেকটা হয়েছে। প্রথমেই ইচ্ছা ছিল প্রাইমারি, পরে মাধ্যমিক স্কুল এবং কলেজ পর্যন্ত যে যাব, সেটাই অনিশ্চিত ছিল। আমি এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছি—এই খুশিতে মিষ্টি খাওয়াব সেই সামর্থ্যও ছিল না। জিপিএ-৫ কি, বাবা-মা বুঝত না, পাস করেছি—এটা বুঝত শুধু।’
পড়াশোনার আগ্রহটা কীভাবে তৈরি হলো? এর উত্তরে প্রশান্ত বলেন, প্রাইমারিতে যখন পড়ি, তখন এক শিক্ষক আমার খোঁজ খবর নিতেন। তখন থেকেই আগ্রহটা তৈরি হতে থাকে। মাধ্যমিক স্কুলেও এমন অনেক শিক্ষক পেয়েছি। তাদের অনুপ্রেরণা ছিল।
কলেজে যে পড়ব—এটা কল্পনাও করিনি। কলেজ শব্দের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম না। আমার এক শিক্ষকের মাধ্যমে নীলফামারী প্রতিনিধি বাড়ি এসে আমার তথ্য নেন, ছবি তোলেন। পরে আমাকে নিয়ে প্রথম আলোয় প্রতিবেদন ছাপা হয়। আমার পড়াশোনার দায়িত্ব নেয় ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী তহবিল। পরে আর পেছনে তাকাতে হয়নি আমাকে। এর পর থেকে প্রথম আলো আমার জীবনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। আজকের যে প্রশান্ত—এটার কৃতিত্ব প্রথম আলো ট্রাস্টের ও ব্র্যাক ব্যাংকের।’
আমরা অদম্য—যাকে দমন করা যায় না। এটা মনে রাখতে হবে এবং এই শক্তি বুকে ধারণ করে এগিয়ে যেতে হবে। সফলতা আসবেই।
শিক্ষক হতে চাইলেন কেন প্রশান্ত? এর উত্তরে তিনি জানান, ‘শিক্ষক হওয়ার আনন্দ অনেক, যেটা আমি এখন পাচ্ছি। এর আগে আমি একটা প্রকল্পে ছিলাম। পরে শিক্ষকতায় আসি। আমাকে কিছু একটা করতেই হবে, কারণ পরিবারকে সাপোর্ট করতে হবে। আমার শিক্ষকেরা যেভাবে আমাকে আগলে রেখেছেন আমিও সেটা করি। সবাই আমাকে পছন্দ করে। আমি মানুষের পাশে থাকতে চাই। আমার জীবনটা মানুষের উপহারে পরিপূর্ণ। আমাকে সহযোগিতা করেছেন অনেকে। আমি সাধারণ মানুষের পাশে থাকতে চাই।’
বাবা-মার অনুভূতি কি? এর উত্তরে প্রশান্ত বলেন, ‘তাঁরা অনেক খুশি। মাকে মাস্টারের মা বলে সম্বোধন করে। এতে মা অনেক খুশি হন।’
এখন যারা অদম্য আছে তাদের পরামর্শ দিয়ে প্রশান্ত বলেন, ‘আমদের জীবনে চলার পথে অনেক বাধা বিপত্তি থাকবেই। এটা অতিক্রম করতে হবে। আমাদের প্রকৃত মেধাকে ব্যবহার করতে হবে, কাজে লাগাতে হবে। আমাদের মতো পরিবারে অর্থনৈতিক সমস্যাসহ নানা সমস্যা থাকে। তবে থেমে থাকা যাবে না। আমরা অদম্য—যাকে দমন করা যায় না। এটা মনে রাখতে হবে এবং এই শক্তি বুকে ধারণ করে এগিয়ে যেতে হবে। সফলতা আসবেই।’
প্রথম আলো ট্রাস্টের নিয়মিত আয়োজন ‘অদম্য মেধাবীর সঙ্গে’ অনলাইন এই অনুষ্ঠানটি একযোগে প্রচার করা হয় প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ইউটিউব চ্যানেল এবং প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ফেসবুক পেজ থেকে। সঞ্চালনায় ছিলেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা।