ব্যাগ বিক্রি, রাজমিস্ত্রির কাজ করেও পড়াশোনা ছাড়েননি জহিরুল

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের জুনিয়র হিসাব সহকারী হিসেবে যোগ দিয়েছেন অদম্য মেধাবী মো. জহিরুল ইসলাম।

প্রথম আলো ট্রাস্টের নিয়মিত আয়োজন ‘অদম্য মেধাবীর সঙ্গে’ অনলাইন অনুষ্ঠানে এ পর্বের অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের জুনিয়র হিসাব সহকারী মো. জহিরুল ইসলাম। কুমিল্লার দাউদকান্দি বরকোটা গ্রামের ছেলে তিনি। তাঁর বাবা বাঁশের তৈরি জিনিসপত্র বিক্রি করে সংসার চালতেন। বাবার আয়ে সংসার চলত না বলে জহিরুলও হাটে জালির ব্যাগ বিক্রি করতেন, দোকানে দোকানে গিয়ে ব্যাগ দিতেন। এক সময় পড়াশোনা বাদ দিয়ে ইলেকট্রিক কাজও করেছেন। পরে রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসাবে কাজ করেছেন। এত কিছুর মধ্যেও পড়াশোনায় ফাঁকি দেননি তিনি। সব সময় ভালো ফল করেছেন। হয়েছেন সফলও। কীভাবে সফল হলেন সেই গল্প ওঠে এল ১৭ আগস্ট ২০২৪, শনিবার, বেলা ৩টায় অদম্য মেধাবীর সঙ্গে অনলাইন আয়োজনে।

জহিরুলের বাবা বাঁশের তৈরি জিনিসপত্র তৈরি করতেন। তার ক্ষুদ্র আয়ে কোনোরকম চলতো তাদের পরিবার। সংসারের দুরবস্থায় সহায়তা করতে তাঁর বড় বোনরা পাঞ্জাবিতে হাতের কাজ করে কিছু আয় করত। এতেও যখন তেমন কোন উন্নতি হলো না, জাহিরুলের বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন অন্যের জমি লিজ নিয়ে তাতে চাষাবাদ করবেন। জমিতে চাষ করা, সবজি বাজারজাত করা মিলিয়ে ছিল অনেক কাজ। এই কাজে সহযোগিতা করতে জহিরুলের বড় ভাই ক্লাস ফাইভে পড়াকালীন পড়াশোনা ছেড়ে দিলেন। জহিরুলও পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য সময়ের অভাব হতে লাগল। প্রয়োজনের স্বার্থে পড়াশোনায় সময় দেওয়ার চেয়ে কৃষি কাজে সময় দিলে তাদের রোজগার একটু ভালো হতো। তারপরও পড়াশোনাটা ছাড়েননি জহিরুল। অদম্য মনোবল নিয়ে এগিয়ে গেছেন। 

জহিরুল ছোট থেকেই একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তাঁর সহায়তায় এগিয়ে এসেছিল অনেকেই। জহিরুল যেই দোকানে জালির ব্যাগ বিক্রি করত, সেই দোকানের মালিক জহিরুলকে একটি গাইড বই দিয়েছিল, এমনকি জহিরুলের শিক্ষকেরা মাসের বেতন নিতেন না।

ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী তহবিল’ থেকে শিক্ষাবৃত্তি পেয়ে এইচএসসি ও স্নাতক পর্যন্ত পড়াশোনা সম্পন্ন করেন জহিরুল।

তার সফলতায় তার বাবা ও শিক্ষকদের অনুভূতির কথা জানতে চাইলে জহিরুল বলেন, ‘আমি যখন ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পাই আমার বাবা খুশিতে আমাকে বুকে জড়িয়ে নেয়। শিক্ষকরাও অনেক গর্ববোধ করেন। সাহস দেন আরও পরিশ্রম করার।’

এসএসসি পরীক্ষা দিয়েই অদম্য জহিরুল নানান কাজে লেগে পড়েন পরিবারকে সহযোগিতা করার জন্য। কাজ করেন রাজমিস্ত্রি সহকারী হিসেবে। এমতাবস্থায় এসএসসিতে ভালো ফলাফল করলেন তিনি। সে বছর এসএসসি ফলে দাউদকান্দিতে সপ্তম স্থান ও নিজের স্কুলে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন তিনি। এ নিয়েও দুশ্চিন্তায় পরলেন, এত ভালো ফলাফল নিয়ে কত দুর আগাতে পারবেন?

ওই সময়টাতে জহিরুলের প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক আজিজুর রহমান স্যার প্রথম আলোর স্থানীয় প্রতিনিধির সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন। পরে প্রথম আলোর স্থানীয় প্রতিনিধি জহিরুলদের বাড়িতে যান। তাদের খোঁজ-খবর নিয়ে প্রথম আলো প্রতিবেদন করেন। পরে তাঁর ভালো ফল, পড়াশোনার প্রতি অদম্য ইচ্ছা ও পারিবারিক অবস্থা বিবেচনায় তাঁকে ‘ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী তহবিল’ থেকে শিক্ষাবৃত্তি প্রদান করা হয়। এই শিক্ষাবৃত্তি পেয়ে জহিরুল এইচএসসি ও স্নাতক পর্যন্ত পড়াশোনা সম্পন্ন করেন।

জহিরুল ২০১৬ সালে ঢাকা কলেজে হিসাববিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। পাশাপাশি চালিয়ে যান টিউশনি, ফ্রিল্যান্সিং ও গ্রাফিকস ডিজাইনের কাজও। স্নাতক শেষে নানান সরকারি চাকরির জন্য পরীক্ষা দেন তিনি। উত্তীর্ণ হয়ে যান বাংলাদেশ বিদ্যুৎ বোর্ডের পরীক্ষায়। ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্টের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে জহিরুল বললেন, ‘এই বৃত্তি পাওয়াতে আমার পড়াশোনা করার পথ অনেকটাই সহজ হয়ে গিয়েছিল। প্রচণ্ড সাহস পেয়েছি। জীবনসংগ্রামে অনেক কিছু শিখতে পেরেছি। আমার শিক্ষিত হয়ে চাকরি করে পরিবারের পাশে দাঁড়ানো সম্ভব হয়ে উঠেছে।’