সম্প্রতি মারুফা মানিকগঞ্জের শিবালয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জয়েন করেছেন। আজ মারুফার গল্প শুনব। স্বাগত মারুফা, কেমন আছেন?
মোছা. মারুফা খাতুন: আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন?
ভালো আছি মারুফা। সেপ্টেম্বর ৩০ তারিখে জয়েন করলেন সিনিয়র স্টাফ নার্স হিসেবে। অনুভূতি জানতে চাই সবার আগে, কেমন লাগছে?
মোছা. মারুফা খাতুন: আলহামদুলিল্লাহ, মানুষের সেবা করতে পারব এ জন্য অনেক ভালো লাগছে।
ছোটবেলা থেকে কি ইচ্ছে ছিল?
মোছা. মারুফা খাতুন: ছোটবেলা থেকে ইচ্ছে ছিল মানুষের সেবা করব। তখন থেকে মনে হতো ডাক্তার হব। যেহেতু মানুষের সেবা ডাক্তার হয়ে সবচেয়ে কাছ থেকে করা যায়। তো এইভাবেই আগাচ্ছিলাম।
আমার একদম ছোটবেলার গল্পটা তাহলে শুনি। মানে স্বপ্নটা যখন দেখতে শুরু করলেন সেই সময়ের গল্পটা শুনি। একদম ছোটবেলাটা কেমন কেটেছে? কোথায় কেটেছে?
মোছা. মারুফা খাতুন: গ্রামেই আমার ছোটবেলাটা কেটেছে। আমার বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলায়, রায়গঞ্জ উপজেলা, লাহোর গ্রাম। আমার বাবা কৃষক, আমার মা গৃহিণী। আমরা দুই ভাই এক বোন। আমার বাবা মাঠে কাজ করে এবং উনি চাইছিলেন যে ওনার ছেলে-মেয়েদের উনি পড়াশোনা শেখাবেন। ওই লক্ষ্যেই উনি আর আমার আম্মা এক সাথে কষ্ট করে। সঙ্গে আমরা ছিলাম, স্ট্রাগল করেই আমার ভাইয়াদেরকে মাস্টার্স কমপ্লিট করায়। আমি তো এখন নার্সিং কমপ্লিট করে এখন সিনিয়র স্টাফ নার্স নন-ক্যাডার পদে মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আছি। ছোটবেলা থেকেই আমি মানুষের খুব কাছে যেতে পছন্দ করি বা মানুষকে হেল্প করতে পছন্দ করি। এটা আমি প্রথম নোটিশ করি যখন দেখি কেউ অসুবিধায় পড়লে আমি আগে গিয়ে সাহায্য করি। এটা একদম ছোটবেলা থেকে সহজাত হয়ে গেছে আমার।
আপনি বলছিলেন যে আপনার বাবা-মা অনেক কষ্ট করে আপনাদেরকে পড়াশোনা চালিয়ে নিয়ে গেছেন এবং তারা মূলত আপনাদের স্বপ্নটাকে পূরণ করবার জন্য তাদের সর্বোচ্চটুকু দিয়েছে। স্বপ্নটা দেখতে শুরু করলেন কবে থেকে?
মোছা. মারুফা খাতুন: তাঁরা যেহেতু পড়াশোনা করতে পারে নাই, তাঁরা চাইছিলেন যে ওনার ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা করাবে। আমরাও চেষ্টা করেছি। বাবা-মায়ের সঙ্গে একাত্মাভাবে নিজেরা চেষ্টা করে এই পর্যন্ত আসতে পারছি আরকি। চাইছিলাম ডাক্তার হইতে, কিন্তু এডমিশনে যখন হলো না, এমবিবিএসে চান্স পাইলাম না, তখন একটু কষ্ট পাইছিলাম। তারপরে মনে হলো যে না, আমি তো হেল্প করতে চাই মানুষের, তাহলে আর কিভাবে করা যায়? এরপরে আমি নার্সিংয়ে পরীক্ষা দিলাম। নার্সিংয়ে আমি অ্যাডমিশনের চান্স পেয়ে গেলাম।
নার্সিংটা শেষ করলেন কোথা থেকে? কবে শেষ হলো?
মোছা. মারুফা খাতুন: নার্সিং শেষ করছি নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কলেজ, টাঙ্গাইল থেকে। ২০২০-এ আমার একাডেমিক পড়াশোনা শেষ এবং আমি যে লাইসেন্স প্রাপ্ত হই সেটা ২০২১ সালে। ওটা তো নার্সিং গেল। এরপরে আমি ডিপ্লোমা ইন কার্ডিয়াক নার্সিং যেটা পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন একটা কোর্স, এটা করেছি ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হসপিটাল থেকে। আলহামদুলিল্লাহ, আমি একজন রেজিস্টার্ড কার্ডিয়াক নার্স বাংলাদেশের।
বাহ! খুবই আনন্দের খবর, খুবই খুশির খবর। কতদিন কোর্সটা করতে হলো?
মোছা. মারুফা খাতুন: আমার ডিপ্লোমাটা কার্ডিয়াক নার্সিংয়ের এক বছরের। দেড় বছর লেগেছে ফাইনাল পরীক্ষা দিতে। তারপরে আমি ওখানেই স্টাফ নার্স হিসেবে জয়েন করি। সব মিলে তিন বছরের মতো ছিলাম ওখানে।
ইব্রাহিম কার্ডিয়াক থেকে পরে এখানে জয়েন করলেন।
মোছা. মারুফা খাতুন: তারপরে নন-ক্যাডারের যে সার্কুলার হলো, তো সেখানে এপ্লাই করি এবং প্রিলিমিনারি, লিখিত, ভাইভা সবকিছু ফেইস করে নন-ক্যাডারে জয়েন দিলাম আলহামদুলিল্লাহ।
আচ্ছা, তার মানে পড়াশোনাটার একটা লম্বা জার্নি গেছে, একটা লম্বা কষ্ট গেছে। এখন বাবা-মায়ের কাছে একটু ফিরে যেতে চাই, তারা এখন কী বলেন?
মোছা. মারুফা খাতুন: আমার আব্বা-আম্মা অনেক খুশি। মানে তাঁরা আসলে চাইছিলেন আমাকে ভালো একটা পজিশনে দেখতে। আমি মানুষের সেবা করব এটা দেখতে। তাঁরা সব সময় বলেন যে, আমাদের মতো মানুষই যায় হসপিটালে, ওরা তো কিছু বলতে পারে না। তুমি তোমার দিক থেকে যথেষ্ট চেষ্টা করবা মানুষের পাশে দাঁড়ানোর, অসুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর। আসলে আমার তো উপজেলা লেভেলের পোস্টিং হয়েছে, তো এখানে যারা যায় ওদের সঙ্গে অনেক কথা বলতে হয়। মানে বোঝাতে হয়, ওদের মতো করেই বোঝাতে হয়। এখানে অনেক ধৈর্যের আমি যথেষ্ট চেষ্টা করি তাদের বুঝিয়ে কথা বলার। সম্প্রতি আমি এখানে যোগদান করেছি। এর মধ্যেই আমার অনেক সুন্দর কিছু মুহূর্ত আছে। আমাদের হসপিটালে সিভিল সার্জন ভিজিট করবেন। সেই উপলক্ষে আমরা সবাই মিলে ওয়ার্ড গুছিয়েছি। তখন একজন বয়স্ক রোগী, উনি আমাকে ডেকে বলতেছেন, "মা, তোমার নাম কী? " আমি বললাম, "আমার নাম মারুফা। " আমি বললাম, "কেন বলেন? " বলল যে, "না, তোমাদের যে বড় স্যার আসতেছে, আমি ওনার কাছে বলব যে তুমি অনেক ভালো, তোমারে অনেক ভালো পাই আমি। " পরে বললাম, "আচ্ছা ঠিক আছে, বললেন। " তো এ রকম আসলে অনেক হয়। এর আগে আমি কার্ডিয়াক-এ ছিলাম। ওইখানে ওই এ রকম অনেক সুন্দর মুহূর্ত আছে।
এখন আপনি একটা জায়গায় মোটামুটিভাবে থিতু হয়েছেন। তারপরও মানুষের তো নিজের স্বপ্ন, কাজ, প্রফেশন, ক্যারিয়ার যেটাই বলি না কেন, সেটা নিয়ে একটা স্বপ্ন থাকে। একটা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা থাকে। আপনার পরিকল্পনা কি?
মোছা. মারুফা খাতুন: আমি নার্সিংয়ে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিতে চাই। বিদেশে গিয়ে এমএসসি, পিএইচডি ডিগ্রি করার ইচ্ছা আছে। উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে, মানুষের কল্যাণে কাজ করতে চাই। সৃষ্টির সেরা জীবের সেবা করছি, এটা আমার সৌভাগ্য বলে আমি মনে করি।
অনেক শুভকামনা আপনার জন্য। এ পর্যন্ত আসার পুরো সময়টাতে কখনো মনে হয়েছে কি পড়াশোনাটা অনেক কঠিন লাগছে কিংবা আর হয়তো পারব না?
মোছা. মারুফা খাতুন: এইটা হ্যাঁ, মনে হয়েছে। আমি ছোটবেলা থেকে এ রকম। যখন নতুন ক্লাসে উঠতাম আর আমার মন খারাপ হয়ে যাইতো যে আমি পারব কিনা। কিন্তু সাহস নিয়ে এগোতাম। দেখতাম আমি স্কুল টপার, ক্লাস টপার হয়ে যাইতাম। এভাবে নার্সিংয়ে আসলাম। নার্সিংয়ে মূলত যে বইগুলো পড়ানো হয়, ডক্টরদের মতো প্রায় সিমিলার বইগুলো আমরা পড়ি, যেমন সার্জারি, মেডিসিন সবকিছুই। ভয় তো একটু হয়, সবকিছু ইংলিশ মিডিয়াম। এখানে আমার এটাই হয়েছে, প্রথম দিকে ভয় ভয় পাইতাম। তবে শেষের দিকে আমার সিজিপিএ ৩.৯৭ আসলো ৪-এর ভিতরে।
এই ওভারকামটা করতেন কিভাবে? সেই গল্পটাই একটু শুনতে চাই যে সাহস পাইতেন কোথায়?
মোছা. মারুফা খাতুন: সাহস পাইতাম তখনই মন খারাপ হইতো। আমি আমার বাবা-মায়ের কথা ভাবতাম। তারা আমাকে অনেক স্বপ্ন নিয়ে এখানে পাঠাইছেন, আমাকে পড়াশোনা করতে হবে। আমার নার্সিং কলেজের ম্যামরা অনেক ভালো ছিলেন। আমাকে অনেক ভরসা করতেন, আমাকে সব সময় বলতেন, ‘মারুফা তুমি পারবা, চেষ্টা কর।’ তারপর না বুঝতে পারলে ম্যাডামদেরকে বলতাম। ম্যাডামরাও সহযোগিতা করেছেন। আমাকে সামনে নিয়ে কথা বলতে বলেতেন। এভাবে আস্তে আস্তে ভয় কেটে গেছে।
এখন যারা অদম্য আছে, কোনো না কোনো সময়ে তাদের মনে হতে পারে যে এই পড়াটা অনেক কঠিন বা এই পথ চলাটা অনেক কঠিন, বোধয় পারছি না, বোধয় পারব না। তাদের জন্য আপনার কোনো পরামর্শ আছে?
মোছা. মারুফা খাতুন: আমার মনে হয়, আমি এডমিশনে মেডিকেলে চান্স পাইনি, এই সময়টা আমি অনেক ডিপ্রেশনে গিয়েছিলাম। অনেকের এ রকম যায়। মানুষের সেবা করতে হলে বা মানুষের পাশে দাঁড়াতে হলে শুধু যে ডাক্তার হতে হবে বা শুধু যে বড় অনেক কিছু হতে হবে, এ রকম কিছু না। যেরকম আমি নার্সিংয়ে আসলাম। আমি মনে করি যে ওপরওয়ালা চাইছিলেন বলে আমি নার্সিংয়ে আসলাম। কারণ আমার নার্সিংয়ে আসার কোনো প্ল্যান ছিল না। যখন মেডিকেলে চান্স পাইলাম না, তখন এখানে আসলাম। প্রথম দিকে পড়াশোনা নিয়ে একটু চাপ সৃষ্টি হয়েছিল। আমি তো বাংলা মিডিয়ামে পড়াশোনা করেছি। ইংলিশ মিডিয়াম, অনেকগুলা করে সাবজেক্ট। প্রথমে একটু হিমশিম খাইছিলাম। পরে আস্তে ধীরে সব ঠিক হয়ে গেছে। মন স্থির করলাম যে আমাকে পড়তে হবে, বুঝতে হবে।
তাহলে এখন যারা অদম্য তাদের জন্য আপনি কী বলবেন।
মোছা. মারুফা খাতুন: একটু সময় নিয়ে নিজেদেরকে বুঝতে হবে। মানুষের সেবা করার মন-মানসিকতা তৈরি করতে হবে। আমরা এমন একটা প্রফেশনে আছি, যেটা শুধু প্রফেশন না, অসুস্থ মানুষের সেবা করার প্রতিশ্রুতি এটা। তাই আমাদের ভালোভাবে বুঝে পড়তে হবে। কারণ আমাদের সঙ্গে তাদের স্বাস্থ্য, তাদের কল্যাণ জড়িত।
আপনি বলছিলেন যে, মানুষের সেবা করার জন্য শুধু যে ডাক্তার, নার্স হতে হবে, তা না। অন্য প্রফেশনে থেকেও মানুষের সেবা করা যায়। একটু বিস্তারিতভাবে যদি বলতেন।
মোছা. মারুফা খাতুন: আমাদের সবার জায়গা থেকে আমরা মানুষকে সাহায্য করতে পারি। আমরা চাইলেই মানুষের জন্য কাজ করতে পারি। আমরা অনেক সময় ধৈর্য হারিয়ে ফেলি। আমি নার্স, আমার কাছে প্রতিদিন অনেক অনেক পেশেন্ট আসবে, অনেক অনেক রোগী আসবে, আমার অনেক কথা বলতে হবে। ধৈর্য নিয়ে তাদের কথা শুনতে হবে, বোঝাতে হবে। বিশেষ করে আমরা গ্রাম লেভেলে যারা কাজ করি, তখন দেখা যায় বেশির ভাগই শিক্ষিত না, এটা আমাকে বুঝতে হবে। তারা আসলে কী বলতে চাইছে, এইটা বুঝে তাকে ভালোভাবে বোঝাতে হবে।
মোট কথা মানুষের জন্য বা মানুষকে সাহায্য করতে চাইলে সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে মানসিকতা। চাইলেই আমরা যেকোনো পেশায় থেকেও সাহায্য করতে পারি। অনুষ্ঠান শেষ করার আগে আপনার যদি এই দীর্ঘ পথ চলার পথে বাবা-মা, পরিবারের যারা আছেন তাদের জন্য যদি কিছু বলতে চান।
মোছা. মারুফা খাতুন: আমার বাবা-মা ছোটবেলা থেকেই দেখছি আমাদের তিন ভাই-বোনের জন্য কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। আমার ভাইয়েরা আমার প্রতি অনেক পজিটিভ এবং অনেক সহযোগিতা করেছে। তারপর এসএসসির পর থেকে আমার প্রথম আলোর সঙ্গে যুক্ত হই ২০১৫ সালে। তখন থেকে এইচএসসি পড়াশোনা ও অন্যান্য সময়ে নানাভাবে প্রথম আলোর সহযোগিতা পেয়েছি। আর সবচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি প্রথম আলোর প্রতিনিধি সাজেদুল আলম স্যারের জন্য। সব সময় চেষ্টা করব প্রথম আলো, সাজেদুল আলম স্যার, আমার পরিবার সবার সম্মান রেখে জীবনে এগিয়ে যেতে চাই এবং মানুষের সেবা করে যেতে চাই। আরও পড়াশোনা করে মানুষের কল্যাণে কাজ করে যেতে চাই।
অনেক ধন্যবাদ মারুফা। আপনার সব স্বপ্নগুলো পূরণ হোক। আপনি মানুষের সেবা করে যেতে চান এবং তার জন্য যতটুকু পড়াশোনা করা দরকার, যতটুকু নিজেকে উন্নত করা দরকার আপনি সেইভাবে নিজেকে তৈরি করবেন। আপনার এই স্বপ্নটা বেঁচে থাকুক এবং সত্যি হোক। আপনার বাবা-মার প্রতি অনেক কৃতজ্ঞতা। আপনার জন্য অনেক শুভকামনা, আপনার ব্যক্তিগত জীবনের, পেশাগত জীবনের সর্বাঙ্গীণ সফলতা কামনা করছি।
মোছা. মারুফা খাতুন: আপনাদেরকেও ধন্যবাদ।