যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন, সেখানেই শিক্ষকতা করছেন অদম্য খাইরুম

সম্প্রতি নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন অদম্য খাইরুম ইসলাম।

খাইরুম ইসলামের বাবা মারা যান ২০০৭ সালে। মা ছিলেন শিক্ষক। কিন্তু অসুস্থ হয়ে পড়ায় শিক্ষকতা ছেড়ে দেন। পুরোপুরি সুস্থ না হওয়ায় কোনো কাজ করতে পারেন না। এমন অবস্থায় দিশেহারা হয়ে পড়েন মা। ‍কিভাবে চলবে সংসার, মেয়ের পড়াশোনাই বা করাবেন কীভাবে। তখন আত্মীয়স্বজন ও স্কুলের শিক্ষকদের সহায়তায় পড়াশোনা চালিয়ে যান খাইরুম। ‍কিন্তু সব সময় তো আত্মীয়স্বজনেরা সহায়তা করতে পারেন না। তাই খাইরুম নিজেই টিউশনি করে পড়াশোনার খরচ চালাতে থাকেন। এভাবে পড়াশোনা করে ২০১৫ সালে ঢাকার সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় দিয়ে বিজ্ঞান বিভাগে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পান। পরে প্রথম আলো ট্রাস্টের অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক ড. ফজলে এলাহীর সহায়তায় শিক্ষাবৃত্তির দেওয়া হয় তাকে। এই বৃত্তির এইচএসসি ও স্নাতক পর্যায়ে পড়াশোনা করেন তিনি। সম্প্রতি নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন। এর আগে প্রাইমএশিয়া ইউনিভার্সিটির সিএসই বিভাগে প্রভাষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন তিনি।

প্রথম আলো ট্রাস্টের নিয়মিত অনলাইন আয়োজন 'অদম্য মেধাবীর সঙ্গে’ অনুষ্ঠানের অতিথি হয়ে এসেছিলেন খাইরুম ইসলাম। গত ১২ অক্টোবর ২০২৪, শনিবার, বেলা ৩টা ৩০ মিনিটে প্রথম আলো ট্রাস্টের এ অনুষ্ঠানে তাঁর সফল হওয়ার পেছনের গল্প ওঠে আসে।

মানুষের খারাপ সময় যায়, তখন মনে হয়ে আর হবে না—এমনটা মনে করা যাবে না। যিনি আমাদের পাঠিয়েছেন তিনি নিশ্চয় একটা প্ল্যান করেই পাঠান। সুতরাং ভরসা রেখে এগোতে হবে।

অনুষ্ঠানের শুরুতে খাইরুম বলেন, ‘আমার বয়স যখন ৮ বছর তখন ঘুমের মধ্যে বাবা মারা যান। বাবা ব্যবসা করতেন। মা ব্যবসার কিছুই জানত না। তাই ওটা চালু থাকেনি। তারপর মা নানাভাবে আমাকে টেনে এখানে এনেছেন। বলতে পারেন, মায়ের কারণেই আজকের আমি হতে পেরেছি। বাবা বেঁচে থাকতে আমি সাউথ পয়েন্ট স্কুলে পড়তাম। বাবা চলে যাওয়ার পর কীভাবে পড়াশোনা চালাব—ভালো ছাত্রী হওয়া সাউথ পয়েন্টের অধ্যক্ষ হামিদা আলী ম্যাডাম আমাকে ডেকে সাহস দিলেন, সহযোগিতা করলেন।’

পরক্ষণেই যুক্ত করে বলেন, ‘শুরুতে হয়তো আমি বুঝতাম না, এখন বুঝি মা আমার জন্য কি করেছেন। অষ্টম শ্রেণি থেকে এসএসসি পর্যন্ত রমেন স্যার আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছেন। বিনা বেতনে পড়াতেন। আমি জীবনে অনেক ভালো শিক্ষক পেয়েছি। এভাবে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেলাম। এদিকে মা অসুস্থ। এখন কী করব! তখন আমার শিক্ষক রমেন স্যার প্রথম আলোতে যোগাযোগ করিয়ে দেয়। তারপর আমার সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় ফজলে এলাহী স্যারের মাধ্যমে আমাকে শিক্ষাবৃত্তির আওতায় নেওয়া হয়। বৃত্তি সহায়তায় ভালো করে পড়াশোনা করে এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পাই। আমাকে পুনরায় স্নাতকের জন্যও বৃত্তির আওতায় রাখা হয়।’

খাইরুম জানালেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য পড়াশোনা করলাম। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়নি। তখন অনেকটা ভেঙেই পড়েছিলাম। পরে আমার মায়ের যা কিছু ছিল তা দিয়ে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে সিএসই বিভাগে ভর্তি হই। তবে আমার ভালো ফল থাকায় ওয়েভার পাই। তারপরও চলতে পারছিলাম না। কারণ মা অসুস্থ, তা ছাড়া কোনো আয়ের পথ নেই আমাদের। তখন ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির বোর্ডের ট্রাস্টিদের আমার পরিবারের সার্বিক তথ্য খুলে বলি। সব শুনে তিনি কেঁদে দেন। আমার দায়িত্ব নেন। প্রথম আলো ট্রাস্টের বৃত্তি, টিউশনি ও অনলাইনে জব করে সংসার চালাতে হয়েছে আমাকে।’

শিক্ষক হতে চাইলেন কেন? এর উত্তরে তিনি জানান, আমি জীবনে অনেক ভালো শিক্ষক পেয়েছি। আমার শিক্ষকদের দেখেই এই আগ্রহটা তৈরি হয় আমার। যেমন রমেন স্যার, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ম্যাডাম—তাদের থেকেই অনুপ্রাণিত হয়েছি। ড. জয় সামাদ স্যার, ডিন স্যার আমাকে এমএসসি করতে বলেন। আমি বলি, আমার ভর্তি হওয়ার সামর্থ্য নেই। ওনারা বলেন, এটা নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। পরে এমএসসি ভর্তির ভাইভা দিতে গিয়ে টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে একটা জব পেয়ে যাই। এটা আমাকে অনেক হেল্প করেছে। মোটকথা চারদিক থেকে সহযোগিতা পেয়েছি।’

খাইরুম আরও বলেন, ‘আমি যখন স্নাতকে অধ্যয়নরত ছিলাম, তখন প্রথম আলোর শিক্ষাবৃত্তি আমার ল্যাব ফি, খাতাকলম কেনা, যাতায়াতসহ অন্যান্য খরচ চালাতে সহায়তা করেছে। তা ছাড়া প্রথম আলো থেকে আমার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগও করেছে।’

যদি মনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে হলো না, হতাশ হওয়ার কিছু নেই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও নানা বৃত্তির ব্যবস্থা আছে। যোগাযোগ করতে হবে, নিজের সমস্যার কথা জানাতে হবে। কখনো হার মানা যাবে না। যদি পড়ার ইচ্ছা থাকে তাহলে ব্যবস্থা হয়েই যায়।

দুইটা বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে এসে এখন নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে যুক্ত হলেন, অভিজ্ঞতা কেমন? এর উত্তরে খাইরুম বলেন, প্রাইমএশিয়া ইউনিভার্সিটিতে প্রথম শিক্ষকতা শুরু করি। তখন কিছুটা নার্ভাস ছিলাম। পরে ইউল্যাব ইউনিভার্সিটিতে যুক্ত হই। এই সময়টাতে আমার মাস্টার্সের থিসিস ডিফেন্স ছিল। তাই অনেক দৌড়ঝাঁপের মধ্যে ছিলাম। আর এখন নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন করেছি। এটা একটা অন্যরকম ভালো লাগা আমার।’

এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে খাইরুম জানান, ‘আমি আমার মায়ের কথা বলতে চাই। মা আমার জন্য অনেক সেক্রিফাইস করেছেন। এ সময় খাইরুম কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন…। আমাকে কখনো একা ছাড়েননি। মাস্টার্সে পড়ার সময় আমি ক্লাস করতাম আর মা নিচে বসে থাকত।’

শিক্ষাবৃত্তির বিষয়ে কোন পরামর্শ দেবেন কি? এর উত্তরের তিনি বলেন, ‘যদি মনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে হলো না, হতাশ হওয়ার কিছু নেই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও নানা বৃত্তির ব্যবস্থা আছে। যোগাযোগ করতে হবে, নিজের সমস্যার কথা জানাতে হবে। কখনো হার মানা যাবে না। যদি পড়ার ইচ্ছা থাকে তাহলে ব্যবস্থা হয়েই যায়।’

এমন দৃঢ় মনোবল যার, তাঁর স্বপ্নটা বড় হওয়ারই কথা। খাইরুম জানালেন, ’শিক্ষকতার সঙ্গেই থাকবেন। দেশের বাইরে থেকে ডক্টরাল ও পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে দেশের জন্য কাজ করবেন এবং তাঁর মতো যাঁরা সংগ্রাম করে পড়াশোনা করছেন তাদের পাশে দাঁড়াবেন। দৃঢ় চিত্তে বলেন, ‘প্রথম আলো, ড. ফজলে এলাহী স্যার, ড. জয় সামাদ স্যার যেমন মানুষের পাশে দাঁড়ান, আল্লাহ যদি সামর্থ্য দেন আমিও এ রকম কিছু করব ইনশাআল্লাহ।’

সবার উদ্দেশ্যে খাইরুম বলেন, ‘মানুষের খারাপ সময় যায়, তখন মনে হয়ে আর হবে না—এমনটা মনে করা যাবে না। যিনি আমাদের পাঠিয়েছেন তিনি নিশ্চয় একটা প্ল্যান করেই পাঠান। সুতরাং ভরসা রেখে এগোতে হবে। থেকে থাকা যাবে না—ভালো কিছু হবেই।’

অনলাইন এই অনুষ্ঠানটি একযোগে প্রচার করা হয় প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ইউটিউব চ্যানেল এবং প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ফেসবুক পেজ থেকে। সঞ্চালনায় ছিলেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা।