অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তি
দারিদ্র্য জয় করে পরিবারের প্রথম গ্র্যাজুয়েট হলেন নুরজাহান
কুড়িগ্রাম পৌরসভার কৃষ্ণপুর দালালীপাড়া গ্রামের মেয়ে নুরজাহান আক্তার। বাবা ভ্যানচালক। বাবার অল্প আয়ে সংসার চালানো কঠিন। দারিদ্র্যের কশাঘাততো ছিলই, তারপরও মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়ে সামাজিক নানা প্রতিকূলতা দেখেছেন। কিন্তু পড়াশোনার প্রতি অদম্য আগ্রহ তাঁকে দমাতে পারেনি। শক্ত মনোবল নিয়ে এগিয়ে গেছেন, যাচ্ছেন। গত বছর নুরজাহান দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগ থেকে সালে স্নাতক (সম্মান) সম্পন্ন করেছেন। তিনিই তাঁর পরিবারের প্রথম গ্র্যাজুয়েট সম্পন্ন করা নারী।
টানাপোড়েনের সংসার থেকে আজকের এই জায়গায় আসা ও ভবিষ্যতে কী স্বপ্ন দেখেন—এ সব নিয়ে নুরজাহানের সঙ্গে কথা হয় ১১ ডিসেম্বর ২০২৩, সোমবার, বিকেল ৫টায় প্রথম আলো ট্রাস্টের নিয়মিত আয়োজন ‘অদম্য মেধাবীর সঙ্গে’ অনলাইন অনুষ্ঠানে।
কুড়িগ্রাম থেকে দিনাজপুর—জার্নিটা কেমন ছিল জানতে চাইলে নুরজাহান বলেন, ‘জার্নিটা সহজ ছিল না। সহজ করে নিতে হয়েছে। আমার বয়স যখন ৪ বছর তখন বাবার ব্যবসায় লস হয়েছিল। তখন আমাদের বাড়ি, জায়গা সব বিক্রি করে ব্যবসার ঋণ পরিশোধ করে। কুড়িগ্রাম সদর থেকে একটু দূরে জমি কিনে টিনের বাড়ি করে। বাবা আবার বিস্কুট, চানাচুরের বিজনেস শুরু করে। ২০১১ সালে, আমি যখন জেএসসি পরীক্ষা দেব, তখন আমাদের পরিবারে আবার বিপর্যয় নেমে আসে। বাবার বিজনেসে লস হয়েছিল, আমাদের বসতবাড়ির জায়গায় ৫ শতক জমি রেখে বিক্রি করে, তখন পরিবারে ভরণ পোষণ, দুই ভাইবোনের পড়াশোনা আমার বাবার পক্ষে কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। তখন আমার এক চাচার সাহায্যে ভ্যানগাড়ি চালানো শেখেন বাবা।’
পরক্ষণেই নুরজাহান যুক্ত করে বলেন, ‘ছোট থেকেই পড়াশোনায় ভালো ছিলাম আমি। শিক্ষকেরা চিনত, আমার পারিবারিক অবস্থা জানত। সে জন্য শিক্ষকেরা ফ্রি পড়াতেন। এক সময় পরিবার থেকে আমার বিয়ে দেওয়া কথা ওঠে। বাবা আমাকে বিয়ে দিতে চান, আমার ভাইকে পড়াশোনা করাইতে চান। কিন্তু আমি পড়াশোনা করতে চাই, বিয়েতে ‘না’ সম্মতি জানাই। ভালো স্টুডেন্ট হওয়ায় আমার স্যারদের কাছে টিউশন ফি হাফ লাগত, কোন কোন স্যার টাকা নিতেন না। আমি আরও ভালো করে পড়াশোনায় মনোযোগী হলাম। ২০১৪ সালে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হলাম। আমার স্কুলের ইংরেজি শিক্ষক শ্রদ্ধেয় শাহজাহান স্যার, প্রথম আলোর কুড়িগ্রামের প্রতিনিধি সফি আংকেলের সঙ্গে কথা বলে আমার একটা প্রতিবেদন প্রকাশ করেন এবং আমি ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্টের অদম্য মেধাবী হিসেবে সিলেক্ট হই। আমি প্রথম আলোর কাছে চিরকৃতজ্ঞ, প্রথম আলো ট্রাস্ট পাশে না থাকলে হয়তো এসএসসি পাস করা পর্যন্ত আমার পড়াশোনা থাকত। আজ আর স্নাতকোত্তর পাশ করা হতো না।’
নুরজাহান আরও বলেন, ‘দিনাজপুর আসা আমার জন্য সহজ ছিল না। পরিবার চাইত আমি কুড়িগ্রামে পড়ি। কিন্তু আমার ইচ্ছা ছিল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হব। প্রথম ২০১৬-১৭ সেশনে কারমাইকেল কলেজে (রংপুর) ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হই। পরবর্তীতে ২০১৭-১৮ সেশনে পুনরায় ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে পজিশন ছিল। পরে হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ (হি. বি) বিভাগে ভর্তি হই।’
এখন মা-বাবার অনুভূতি কেমন? জানতে চাইলে নুরজাহান জানান, ‘তাঁরা অনেক খুশি, আমাকে নিয়ে গর্বিত। এখন বাবা বুঝেছেন, বিয়ের কথা বলা ঠিক হয়নি। বাসায় বলে দিয়েছি—আগে চাকরি করব, নিজে স্বাবলম্বী হব। পরে বিয়েশাদীর বিষয়ে ভাবব।’
এখন যারা অদম্য মেধাবীরা আছে তাদের জন্য নুরজাহানের পরামর্শ হলো, ‘প্রথম থেকেই সময়টা কাজে লাগাতে হবে। ইংরেজি ভাষা ও কম্পিউটারের দক্ষতা বাড়াতে হবে। আমার যেহেতু সংগ্রাম করে বড় হয়েছি, সেহেতু সময়টা কাজে লাগতে হবে। তানা হলে পিছিয়ে পড়তে হবে।’
কি স্বপ্ন দেখেন? এর উত্তরে বলেন, ‘প্রত্যেক মানুষেরই স্বপ্ন থাকে। মানুষ তাঁর স্বপ্নের সমান। আমারও একটা স্বপ্ন আছে। বিসিএস দিয়ে প্রশাসন ক্যাডারে যেতে চাই। সেটা না হলে ব্যাংক জবগুলোতে চেষ্টা করব। সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন, আমি যেন আমার স্বপ্ন পূরণ করতে পারি।’
প্রথম আলো ট্রাস্টের নিয়মিত আয়োজন ‘অদম্য মেধাবীর সঙ্গে’ অনলাইন এই অনুষ্ঠানটি একযোগে প্রচার করা হয় প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ইউটিউব চ্যানেল এবং প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ফেসবুক পেজ থেকে। সঞ্চালনায় ছিলেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা।