শিশুরোগ তত্ত্বে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে উন্নত সেবা দেওয়ার ইচ্ছা ফরহাদের

নাটোরের অদম্য মেধাবী মো. ফরহাদ মাহমুদ বর্তমানে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত।

নাটোর সদর উপজেলার রামাইগাছী গ্রামের ছেলে মো. ফরহাদ মাহমুদ। সাত ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট তিনি। বাবা দিনমজুরি করে এই বড় পরিবারের ভরণপোষণ করতেন। কোনোমতে টেনেটুনে চলছিল পরিবার। ‍কিন্তু হঠাৎ ঘটে বিপত্তি। ফরহাদ যখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়েন তখন মারা যান। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যুতে পরিবারের অনটন আরও বেড়ে যায়। বড় ভাই তখন রাজমিস্ত্রির কাজ করে কিছুটা জোগান দেন। বড় ভাইয়ের সঙ্গে রাজমিস্ত্রির কাজে যোগ দেন ফরহাদ। এভাবেই কঠোর পরিশ্রম করে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পান। পরে ‘ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী তহবিল’ থেকে শিক্ষাবৃত্তি পেয়ে এইচএসসি ও এমবিবিএস পর্যায়ে পড়াশোনা চালিয়ে যান ফরহাদ। এমবিবিএস শেষ করে বর্তমানে ইবনে সিনা স্পেশালাইজড হসপিটালে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত। শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিজেকে দেখতে চান তিনি।

প্রথম আলো ট্রাস্টের নিয়মিত অনলাইন আয়োজন 'অদম্য মেধাবীর সঙ্গে’ অনুষ্ঠানের অতিথি হয়ে এসেছিলেন মো. ফরহাদ মাহমুদ। গত ১৬ নভেম্বর ২০২৪, শনিবার, বেলা ৩টা ৩০ মিনিটে প্রথম আলো ট্রাস্টের এ অনুষ্ঠানে তাঁর সফল হওয়ার পেছনের গল্প ওঠে আসে।

অনুষ্ঠানের শুরুতে ফরহাদ বলেন, ‘ছোটবেলায় তেমন কোন স্বপ্ন ছিল না আমার। অভাবের সংসার ছিল। বাবা ছিলেন একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি। আমি যখন ৭ম শ্রেণিতে পড়ি তখন বাবা মারা যান। তখন অনেক সমস্যার মধ্যে পড়ে যাই আমরা। যা হোক কঠোর পরিশ্রম করে পড়াশোনা চালিয়ে যাই। ৫ম ও ৮ম শ্রেণিতে বৃত্তি পাই। এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাই। এর পর কীভাবে পড়ব সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলাম। তখন প্রথম আলোর নাটোর প্রতিনিধি মুক্তার আঙ্কেল আমাকে নিয়ে প্রতিবেদন করেন। তারপর আমার সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় আমাকে ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম প্রথম আলো ট্রাস্টের অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তির আওতায় নেওয়া হয়। এইচএসসিতে পড়ার সময় জীববিজ্ঞানের প্রতি আলাদা আগ্রহ তৈরি হয় আমার। তখন থেকেই ডাক্তার হওয়ার চিন্তা আসে। সে মতে এগিয়ে যেতে থাকি।’

 বৃত্তি সহায়তায় ভালো করে পড়াশোনা করে এইচএসসিতে জিপিএ-ও পাই। আমাকে পুনরায় স্নাতকের জন্যও বৃত্তির আওতায় রাখা হয়। প্রথমবার মেডিকেলে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে গিয়েছিল। সে বছর অনার্স ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে প্রথমে শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। পরের বছর আবার মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষায় দিয়ে ৪০০ তম অপেক্ষমাণ তালিকায় থাকি। পরে এক বড় ভাই আমাকে জানায়, বেসরকারি মেডিকেলে কলেজে ৫ শতাংশ অসচ্ছল দরিদ্র কোটা আছে, এখানে আবেদন কর। পরে গ্রীন লাইফ মেডিকেল কলেজে আবেদন করি এবং ভর্তির জন্য ডাক পাই। পরে ভাইভা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হয়ে যাই— বললেন ফরহাদ।

বর্তমানে ইবনে সিনা স্পেশালাইজড হসপিটালে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত অদম্য ফরহাদ।

এমবিবিএ পাস করে কি করছেন এখন—এমন প্রশ্নের উত্তরে ফরহাদ জানান, ‘ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ইবনে সিনা হাসপাতালে পেডিয়াট্রিক বিভাগে জয়েন করেছি। শিশু বিভাগ পছন্দ করার কারণ হলো, হাসপাতালে ডিউটি করার সময় দেখেছি একটা শিশু সুস্থ হওয়ার পর বাবা-মায়ের মুখে যে হাসিটা দেখা যায়, ওটা অতুলনীয়। তখন চিকিৎসক হিসেবে আমাদেরও অনেক ভালো লাগা কাজ করে। সেই ভালো লাগা থেকেই শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ পছন্দ করি।’

পরিবারের লোকজনের অনুভূতি কেমন এখন? এর উত্তরে ফরহাদ বলেন, আমার বাবা নেই। বড় ভাই দিনমজুরি করেন। দিনমজুরি করেও আমাকে সব সময় সাপোর্ট করেছেন। টাকার প্রয়োজন হলে কখনো না করেননি। যখন যা পেরেছেন তাই দিয়েছেন। আমার বাবার অভাব বুঝতে দেননি তিনি। ভাই খুব গর্ববোধ করেন আমাকে নিয়ে।’

কে কোন সেক্টরে যেতে চায়, সেটা ঠিক করতে হবে। আর যারা যে বিষয়ে পড়াশোনা করছে সেটা ভালো করে করতে হবে।

কি স্বপ্ন দেখেন এখন জানতে চাইলে ফরহাদ বললেন, ‘আমার ইচ্ছা আছে পিজিতে এফসিপিএস করার অথবা লন্ডনে গিয়ে এমআরসিপিসিএস করার। উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে দেশের মানুষের সেবা করব—এটাই আমার স্বপ্ন।’

এখন যারা অধ্যয়নরত আছে তাদের জন্য পরামর্শ দিলেন ডা. ফারহাদ। তিনি জানালেন, ‘যে যে বিভাগে বা বিষয়ে আছ সেটাতে মনোযোগ দেবে, সেই জ্ঞানটা প্রপ্রারর্লি ব্যবহার করবে। তৃতীয় বর্ষে এসেই লক্ষ্য ঠিক করে এগোতে হবে।’

পড়াশোনার সময়টা অনেক উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে যায়। অনেক সময় মনে হয় আর তো পারছি না। ঐ সময়টা কিভাবে অতিক্রম করলেন—এমন প্রশ্নের উত্তরে ফরহাদ বলেন, ‘পঞ্চম বর্ষ পর্যন্ত বুঝি নাই। শেষ বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষার সময় মনে হয়েছে আর পারব না। একমাত্র আল্লাহই পারবেন আমাকে উত্তীর্ণ করতে। পরে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হই।’

খারাপ সময়ে মনোবল ধরে রাখার টিপস কি? এ ব্যাপারে ফরহাদ বলেন, ‘আমার মা একমাত্র অবলম্বন। প্রথমবার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যায়। তখন অনেক হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। এ সময় মা-ই আমার পাশে ছিলেন, সাহস দেন। মেডিকেলে যখন ভর্তির সুযোগ হলো তখন কলেজ থেকে বলা হলো ২৫ হাজার টাকা লাগবে ভর্তি হতে। কিন্তু এই টাকাও আমার কাছে অনেক টাকা। মা বলেছে, ব্যবস্থা হয়ে যাবে। পরে শুনেছি এখানে ভর্তি হতে ১৮ লাখ টাকা লেগেছে অন্যদের।’

নতুন অদম্যদের স্বাগত জানিয়ে ফরহাদ বলেন, ‘কে কোন সেক্টরে যেতে চায়, সেটা ঠিক করতে হবে। আর যারা যে বিষয়ে পড়াশোনা করছে সেটা ভালো করে করতে হবে। দেশের জন্য কাজ করা—দেশের বাইরে থেকে দক্ষতা অর্জন করে দেশে এসে কাজ করতে হবে।’

অনলাইন এই অনুষ্ঠানটি একযোগে প্রচার করা হয় প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ইউটিউব চ্যানেল এবং প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ফেসবুক পেজ থেকে। সঞ্চালনায় ছিলেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা।