জীবনে সমস্যা আছে বলেই জীবনটা এত সুন্দর: দৃষ্টি জয়ী রাফি
চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার উজিরপুর গ্রামের দৃষ্টিহীন শিক্ষার্থী মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন রাফি। তিন বছর বয়সে এক দুর্ঘটনায় দুই চোখেরই দৃষ্টি হারান তিনি। প্রয়াত স্কুলশিক্ষক আজহার উদ্দিন ও নাজনীন আকতারের দুই মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে সবার ছোট দৃষ্টিহীন সাইফুদ্দিন। বর্তমানে বাবার স্কুলেই বড়বোন শিক্ষকতা করেন। বড় বোনের আয় এবং বিদ্যালয়ের আর্থিক সহায়তায় চলত সাইফুদ্দিনের পড়াশোনা। বসতবাড়ি ছাড়া কোনো জমাজমি নেই তাদের।
তারপরও পড়াশোনার আগ্রহ থেকে একটুও দমে যাননি তিনি। ক্লাসে শিক্ষকদের পাঠদান মুঠোফোনে রেকর্ড করতেন। বাড়ি ফিরে সেই রেকর্ড শুনে আত্মস্থ করতেন নিজের পড়া। ব্রেইল পদ্ধতি ছাড়াই পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন। এর স্বীকৃতিও পেয়েছেন পদে পদে। ২০১৭ সালে এসএসসি পরীক্ষায় চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের অধীনে মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছেন। তখন প্রথম আলোর প্রতিনিধি তাঁকে নিয়ে প্রতিবেদন করেন প্রথম আলোয়। সবদিক তাঁকে দেওয়া হয় ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তি। বৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা করে ২০১৯ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। পুনরায় শিক্ষাবৃত্তি অব্যাহত রাখা হয় তাঁর। ভালো করে পড়াশোনা করে ২০১৯-২০ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। এখন তিনি শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী।
প্রথম আলো ট্রাস্টের নিয়মিত অনলাইন আয়োজন 'অদম্য মেধাবীর সঙ্গে’ অনুষ্ঠানের অতিথি ছিলেন অদম্য মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন রাফি। গত ১১ মার্চ ২০২৪, সোমবার, বিকেল ৫টায় প্রথম আলো ট্রাস্টের এ অনুষ্ঠানে তাঁর সফল হওয়ার পেছনের গল্প ওঠে আসে।
অনুষ্ঠানের শুরুতে. . আবার এলো যে সন্ধ্যা/শুধু দু’জনে… চলো না ঘুরে আসি অজানাতে…নিজ কণ্ঠে সারা জাগানো এই গান এবং নিজ হাতে বাজানোর গিটারের শব্দে মুখর হয়ে ওঠে স্টুডিও। বলছি মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন রাফির কথা।
ছোটবেলার গল্প বলেতে গিয়ে রাফি জানান, ‘প্রথমেই ধন্যবাদ জানাই প্রথম আলোকে আমার জীবনের গল্প তোলের ধরার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। বাবা চাইতেন ছেলে গান করুক। ছোট থেকেই খেলনা ভেঙে দেখতাম ভেতরে কি আছে—ইঞ্জিনিয়ার হব বলে। কিন্তু সুযোগ হয়নি। এখন ইচ্ছা, ইংরেজির শিক্ষক হব।’
দৃষ্টিশক্তিহীনতা কি জন্মগত নাকি অন্য কোনো কারণে? উত্তরে রাফি জানান, এটা জন্মগত না, দুর্ঘটনাজনিত। বাবা পান খেতেন। একবার বাবা চুনসহ পান রেখেছিলেন। আমি ওটা পেয়ে হাতে নিয়ে চাপ দিতেই ফেটে যায় এবং আমার দু চোখের ভেতর ঢুকে যায়। সেখান থেকে আস্তে আস্তে অন্ধত্তের দিকে যায়। সাধ্যমতো অনেক চেষ্টা করা হয়েছে, তবে আলো ফেরেনি। ব্রেইল ও শ্রুত লিখনের মাধ্যমে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও শ্রুত লেখক নিয়ে পড়াশোনা করি, পরীক্ষা দিই।
গানের প্রতি আগ্রহটা কবে থেকে? এ ব্যাপারে রাফি জানান, ‘ছোটবেলায় খুব হারমোনিয়াম বাজানোর ইচ্ছা করত। কষ্ট করে বাবা কিনেও দিয়েছিল। হাইস্কুলে থাকতে কয়েকজনের কাছে কিছুটা শিখেছি। ২০১৫ সালে বাবা মারা যায়। এরপর কিছুটা বিরতি ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর অন্যান্য আরও ইন্সট্রুমেন্ট শিখেছি, শিখছি।
সারা বিশ্ব ঘোরার একটা ইচ্ছা আছে। অনুভূতি দিয়ে বিশ্ব দেখতে চাই। এগুলো পাশাপাশি মিউজিক নিয়ে কাজ করব— সাইফুদ্দিন রাফি।
সম্প্রতি একটা গানের প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন, এটা নিয়ে কিছু বলুন। রাফি বলেন, ‘আসলে শেষ সময়ে আমি রেজিস্ট্রেশন করি। পরে স্ক্রিন টেস্ট দিই। এটা হোয়াসঅ্যাপে দিয়েছি। সেটা দেখে আমাকে কল করে। পরের রাউন্ডে ‘সেই মেয়েটি আমাকে ভালোবাসে কিনা আমি জানি না’… এই গানটি গেয়েছিলাম। আমি সবার শেষ পারফর্মার ছিলাম। প্রথম গান শুনেই আমার ‘ইয়েস কার্ড’ দেয়।’
ফলাফল কি ছিল? এর উত্তরে রাফি বলেন, ‘প্রথম দিন আমি অনেক নার্ভাস ছিলাম। ইয়েস কার্ড পাওয়ার পর আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। এভাবে পারফর্ম করতে করতে টপটেন-এ চলে আসি। পরে সেরা-৬ এবং ফাইনালে ফার্স্ট রানার-আপ হই। আরটিভির সঙ্গে ১ বছরের চুক্তি হয়েছে আমার।’
পরক্ষণে রাফি যুক্ত করে বলেন, ‘দৃষ্টিহীনদের নিয়ে সমাজে কিছু ভুল ধারণা আছে। দৃষ্টিহীনরা একা চলতে পারে না। কিন্তু আমি এটা মানি না। প্রপার ইন্সট্রুমেন্ট থাকলে অনেক সহজেই কাজ করা যায়। আমি সবই পারি। আমি স্মার্ট ফোন ব্যবহার করি, ফেসবুক টুইটার থেকে শুরু করে সবই ব্যবহার করি। তবে আগের চেয়ে এখন অনেক পরিবর্তন হচ্ছে।’
স্বপ্ন কি দেখেন রাফি? উত্তরের রাফি জানান, ‘নিজেকে একজন শিক্ষক হিসেবে প্রতিষ্ঠিতকরতে চাই। প্রভাষক হিসেবে কাজ করতে চাই। পরে আইইএলটিএস দিয়ে বাইরে যেতে চাই। সারা বিশ্ব ঘোরার একটা ইচ্ছা আছে। অনুভূতি দিয়ে বিশ্ব দেখতে চাই। এগুলো পাশাপাশি মিউজিক নিয়ে কাজ করব।’
এখন যারা অদম্য আছে তাদের জন্য রাফির পরামর্শ দিয়ে রাফি বলেন, ‘প্রতিটা মানুষের কিছু বাধা থাকেই, সমস্যা থাকেই। সেগুলো নিয়েই এগোতে হয়। এটাই স্বাভাবিক। আমাদের আশাবাদী হতে হবে। নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখতে হবে। আমি কি চাই, কি করা উচিত—এগুলো ঠিক করতে হবে। পজিটিভ হতে হবে। নিজের স্পিরিট খোঁজে বের করতে হবে এবং কাজে লাগাতে হবে। তখন দেখবে, কেউ তোমাকে আটকাতে পারছে না। সবশেষ একটা কথা বলতে চাই-জীবনের সমস্যা আছে বলেই জীবনটা এত সুন্দর।’
গানের মূর্ছনায় শুরু হয়ে গানের মাধ্যমেই শেষ হয়। রাফির কণ্ঠে ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই/চিরদিন কেন পাইনা. . এই গান গেয়ে, সুরের মূর্ছনায় ভাসিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হয়।
প্রথম আলো ট্রাস্টের নিয়মিত আয়োজন ‘অদম্য মেধাবীর সঙ্গে’ অনলাইন এই অনুষ্ঠানটি একযোগে প্রচার করা হয় প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ইউটিউব চ্যানেল এবং প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ফেসবুক পেজ থেকে। সঞ্চালনায় ছিলেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা।