মাসুদ আসা মানে এলাকায় ডাক্তার আসা

অদম্য মেধাবী ডা. মাসুদ রানা।বর্তমানে মাসুদ রানা নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন।

ঈদের ছুটিতে ২০ এপ্রিল বাড়ি গেছে মাসুদ রানা। মাসুদ রানা বাড়ি গেলে বাবা-মা যতটা খুশি হন, তার চেয়েও যেন বেশি খুশি হন তাঁর বাড়ির আশেপাশের মানুষজন। কারণ মাসুদ বাড়ি আসা মানে তো কেবল বেড়ানো নয়। মাসুদ আসা মানে এলাকায় ডাক্তার আসা। বিনামূল্যে ডাক্তার দেখানো।   চিকিৎসক হওয়ার পর থেকে অদম্য মেধাবী মাসুদ রানার এলাকার বাস্তবতা এমনই।

মাসুদের আজকের জীবনটা যেন একদম সুন্দর একটা গল্পের মতো। মাসুদের বেড়ে ওঠার গল্পটাও রুপকথার গল্পের চেয়ে কম ছিলোনা। মাসুদ নিলফামারীর ছেলে। নিজেদের ভিটেবাড়ি বলতে কিছু ছিলোনা। বাবা-চাচা অন্যের জমিতে কাজ করে আর মা বাড়িতে গরু লালন পালন করতেন সংসার চালাতেন । মাসুদের পরিবারে স্বচ্ছলতার যতটা অভাব ছিল, তাঁর বাবা-মায়ের চোখে দুই ছেলের জন্য স্বপ্ন যেন তাঁর চেয়েও বেশি ছিল। যাই হয়ে যাক না কেন তাঁরা ঠিক করেই নিয়েছিলেন  দুই ছেলের পড়াশোনা চালিয়ে যাবেন তা সে যেভাবেই হোক।

কর্মস্থলে রোগী দেখছেন ডা. মাসুদ রানা।

স্কুলের শুরুর দিকে মাসুদ আর তাঁর ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ তেমন বেশি না হলেও মাসুদ এবং তাঁর ভাই যতই বড় শ্রেণিতে উঠছিলেন, ততই পড়াশোনার খরচ বাড়ছিল। কিন্তু বাবা মায়ের স্বপ্নটাও যে অনেক বড়। নিজের চেষ্টা আর বাবা মায়ের আশীর্বাদে মাসুদ এসএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়ে যায়। পুরো এলাকায় যেন খুশির বন্যা বয়ে গেলো।  কিন্তু খুশির চেয়ে উচ্চ মাধ্যমিকের পড়াশোনার খরচের দুশ্চিন্তাটাই বেশি ভারী মনে হতে লাগলো। ঠিক সেই সময়েই প্রথম আলোর স্থানীয় প্রতিনিধির লেখায় উঠে আসে মাসুদ রানার যুদ্ধের গল্প। মাসুদ ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তির জন্য নির্বাচিত হন। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষাতেও মাসুদ তাঁর সফলতার ধারাবাহিকতায় জিপিএ ৫ পান। ছোটবেলা থেকেই মাসুদের বাবা মায়ের স্বপ্ন ছিল ছেলে ডাক্তার হবে আর এদিকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে ভর্তির সুযোগ পেলেন মাসুদ। যেই বাবা মায়ের জন্যই আজকে এতদুর আসা, সেই বাবা মায়ের স্বপ্ন পূরণের জন্য দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় মাসুদ রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়ে এমবিবিএস সম্পন্ন করেন।

অদম্য মেধাবী মাসুদ রানা ডাক্তার হয়েছেন। এখন মানুষের সেবা করবেন বলে ব্রত নেন। অবেগে জড়িয়ে ধরেন সম্পাদক মতিউর রহমান। ৩ অক্টোবর ২০১৯ রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে।

বর্তমানে মাসুদ রানা নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন । আজ মাসুদের বাবা-মায়ের স্বপ্ন পুরন হয়েছে, নিজেদের বাড়ি হয়েছে। এলাকার ছেলে মাসুদ যখন ডাক্তার মাসুদ হয়ে বাড়ি ফিরেন, আশেপাশের লোকজন তাঁর কাছে তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে আসেন। এই ঈদেও তার ব্যাতিক্রম হবেনা। এবার ঈদেও মাসুদ পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাবেন। এলাকায় বিনামূল্যে রোগী দেখবেন। মাসুদ রানা বলেন, ‘আমি বাড়ি আসলে আমার এলাকার মানুষজন আমার কাছে তাঁদের নানা সমস্যা নিয়ে আসেন, আমি তাঁদের বিনামূল্যে ব্যবস্থাপত্র দেই। কেবল ঈদ বা কোন ছুটিতে না, আজীবন আমি এমনটাই করে যাবো। এটা আমার বাবা-মায়ের আদেশ। আমার আজকে যা অর্জন তা আমার বাবা-মায়ের অক্লান্ত পরিশ্রম আর ত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া। আমি তাঁদের কথা কোনদিন ফেলতে পারবোনা। আমি এলাকার মানুষের সেবা করলে আমার বাবা-মা যতটা খুশি হন, আমারও ঠিক ততটাই লাগাটা কাজ করে।  আমার এলাকার মানুষের জন্য কিছু করতে পারছি, তাঁদের দোয়া পাচ্ছি, জীবনে এইটা আমার পরম পাওয়া। ঈদের ছুটিতে গ্রামের মানুষের সেবা করবো এটাই আমার ঈদ আনন্দ’। মাসুদ স্বপ্ন দেখেন উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে দেশের মানুষকে আরও উন্নত মানের চিকিৎসা দিতে চান।

‘অদম্য মেধাবী’ শিক্ষাবৃত্তি সারা দেশের গরিব, কিন্তু মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের জন্য খুলে দিয়েছে সম্ভাবনার দুয়ার। অদম্য মেধাবীদের একেকটি গল্প অন্যদের জন্য হয়ে উঠেছে অনন্ত অনুপ্রেরণার উৎস। প্রথম আলো ২০০৭ সাল থেকেই এই শিক্ষাবৃত্তি দিয়ে আসছে। তবে ট্রাস্ট গঠনের পর থেকে এটি নিয়মিতকরণ করা হয়। ২০১০ সালে ব্র্যাক ব্যাংকের যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে এর পরিধি বাড়ে। ব্র্যাক ব্যাংক ও অন্য দাতাদের সহযোগিতায় এখন পর্যন্ত মোট অদম্য মেধাবীর সংখ্যা ১ হাজার ১৩৪ জন শিক্ষার্থী সহায়তা পেয়েছেন। এর মধ্যে ব্র্যাক ব্যাংকের সহায়তায় মোট ৩১৯ জন শিক্ষাবৃত্তি পেয়ে স্নাতক সম্পন্ন করছেন। ব্র্যাক ব্যাংক- প্রথম আলো ট্রাস্ট  অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে মাসুদ রানা ছাড়াও চিকিৎসক হয়েছেন মো. বিপুল মিয়া, মো. মাসুদ রানা, নাজমিন বেগম, আওলাদ হোসেন, মোহাম্মদ শামসুল হক, মো. আবু হোসাইন, মারিয়াম খানম শিমুল, নিলয় কুন্ডু ,গৌরব মজুমদার।