আসমা আক্তার পরিবারের বড় সন্তান।অভাবে সঙ্গে সংগ্রাম করে ২০০৮ সালে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। ভালো ফলাফল করেও কি করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না আসমা। তখন প্রথম আলোতে তাঁকে নিয়ে প্রতিবেদন করা হয়। পরে তাঁর পারিবারিক অবস্থা ও অদম্য মেধাকে বিবেচনায় নিয়ে ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তি প্রদান করা হয়। ২০১০ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। পুনরায় শিক্ষাবৃত্তি অব্যাহত রাখা হয়। তিনি পটুয়াখালী সরকারি কলেজ থেকে ইংরেজি বিভাগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। বর্তমানে তিনি পটুয়াখালীর কলাপড়া উপজেলার নাচনাপাড়া বাসন্তী মন্ডল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত।
টানাপোড়নের সংসার থেকে সফল হওয়া, শিক্ষক হওয়ার গল্প, ভবিষ্যৎ স্বপ্ন—এ সবকিছু নিয়ে আসমা আক্তারের জীবনের নানা গল্প উঠে আসে ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩,সোমবার, বিকেল ৫টায় প্রথম আলো ট্রাস্টের নিয়মিত আয়োজন ‘অদম্য মেধাবীর সঙ্গে’ অনলাইন অনুষ্ঠানে।
অনলাইন আয়োজনে আসমা আক্তার তাঁর ছোট বেলার গল্প, বড় হয়ে ওঠার গল্প বলতে গিয়ে বলেন, ‘ছোটবেলার যাত্রাটা একটু কঠিন ছিল আমার জন্য। যেহেতু বাবা একজন জেলে, মাছ ধরে সংসার চালান। আমি পড়াশোনা ভালো ছিলাম। ২০০৭ এ সিডরে সব হারাই আমরা— ঘর, বই-খাতা কিছুই ছিল না । তখন আমি দশম শ্রেণিতে পড়ি। এর মধ্যেও জিপিএ-৫ পাই। তখন বাবা চিন্তা করেন— আমাকে পড়াশোনা করাবেন কিনা। কারণ অনেক খরচ হবে। তারপর আল্লাহর অশেষ রহমতে প্রথম আলোর একজন সাংবাদিক ( নেছারউদ্দিন টিপু) আমাদের বাড়িতে আসেন। বাবাকে জিজ্ঞেস করেন মেয়েকে পড়াবেন কিনা। বাবা বলেন, আমার তো সেই সামর্থ্য নেই। তখন ওনারা আমাকে নিয়ে প্রথম আলোয় সংবাদ করেন। পরে সবদিক বিবেচনায় ব্র্যাক ব্যাংক- প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হয়। সেই টাকায় আমি এইচএসসি পড়াশোনা করে আবার জিপিএ-৫ পাই। আমাকে স্নাতক পর্যায়েও বৃত্তির জন্য মনোনীত করা হয়।’
আসমা আরও যুক্ত করে বলেন ‘২০১১ সালে বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। কোন কাজ করতে পারে না। তখন আমার ছোট ভাই শ্রমিকের কাজ শুরু করে, সংসার টেনে নেয়। এই সময়টাতে আমি জাতীয় বিশ্বাবদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে স্নাতক পড়ি। এখানে ৪ বছরের কোর্স ৬ বছর লেগে যায়। আমার ৪ বছরের বৃত্তি শেষ হলেও প্রথম আলোর সহায়তায় আমাকে আরোও দুই বছর বেশি বৃত্তি দেওয়া হয়। আমি স্নাতক শেষ করি। পরে স্নাতকোত্তর বাসা থেকে গিয়ে পড়াশোনা করি। গ্রামের বাড়িতে কোচিং টিউশনি করে কিছু আয় করে বাবার চিকিৎসার খরচ একটু একটু করে দেই। এরই মাঝে চাকরির জন্য চেষ্টা শুরু করি। অনেক কথা শুনতে হয়েছে। গ্রামের মানুষ বলে, ‘এতো ভালো ছাত্রী কিন্তু কিছু হচ্ছে না...’। পরে অনেক প্রচেষ্টায় এ বছর সরকারি প্রাথমিকে সহকারী শিক্ষক পদে চাকরি হলো। এখন বাবাকে পারিবারকে দেখতে পারব।’
টানাপোড়েনের সংসার থেকে কীভাবে সফল হলেন, অনুপ্রেরণাটা কি ছিল? এই প্রসঙ্গে আসমা জানালেন, ‘অনেক সময় মনে হয়েছে হাল ছেড়ে দেই। তবে মনোবল শক্ত ছিল— আমার মনে হয়েছে,আমি পারব। যার জন্য আমি পেরেছি হয়তো। এখানে আপনাদের ধন্যবাদ দিতে চাই কারণ আমাদের মতো ছেলেমেয়েদের পাশে আছেন। আমি আপনাদের সংবর্ধনায় ঢাকা গিয়েছিলাম। তখন দেখেছি-আমার চেয়েও অনেকে খারাপ অবস্থায় আছে। তখন এমনিতেই মনে সাহস চলে আসে। আমি আমার বংশে প্রথম এমএ পাস ও সরকারি চাকরি করছি। এখন সবাই অনেক খুশি। এখন বাবা-মাসহ সবাই খুব খুশি। বাবার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।’ এখন যারা অদম্য মেধাবীরা পড়াশোনা করছেন তাদের জন্য আসমার পরামর্শ হলো, ‘যখন পড়াশোনা শেষ, বয়সও শেষের দিকে, তখন অনেক হতাশা চলে আসে। তাদের বলব— মনোবল হারানো যাবে না, হতাশ হওয়া যাবে না। মা-বাবার কথা চিন্তা করে, তাদের কষ্টের কথা চিন্তা করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা থাকতে হবে। অবশ্যই ভালো কিছু হবে।’ সবশেষে আসমা বলেন, ‘আমার আরেকটা স্বপ্ন আছে, আমি আমার মতো ছেলেমেয়েদের পাশে দাঁড়াব। আমার ক্লাসেই দেখি অনেক অস্বচ্ছল বাচ্চা আছে তাদের বই খাতা, জামা কাপড় এবং বিনা মূল্যে পড়ার চিন্তা আছে। আমার সাধ্য মতো আমি তা করব।’ প্রথম আলো ট্রাস্টের নিয়মিত আয়োজন ‘অদম্য মেধাবীর সঙ্গে’ অনলাইন এই অনুষ্ঠানটি একযোগে প্রচার করা হয় প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ইউটিউব চ্যানেল এবং প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ফেসবুক পেজ থেকে। সঞ্চালনায় ছিলেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা।