‘অদম্য মেধাবীর সঙ্গে’ অনলাইন আয়োজন
‘যেটা পাইনি সেটার জন্য আফসোস না করে, যেটা পেয়েছি ওটাতে ভালো করতে হবে’
নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলায় প্রত্যন্ত গ্রামে মো. নূরুজ্জামানের বাড়ি। রিকশা চালক বাবার অল্প আয়ে সংসার চলত বেশ কষ্টেই। তারপরও অভাব অনটনের সংসারে নিজের ইচ্ছা শক্তির জোড়ে পড়াশোনা করেছেন। অনেক বাধা অতিক্রম করে নিজের চেষ্টায় ২০১১ সালে মাধ্যমিকে জিপিএ-৫ পেয়ে তাক লাগিয়ে দেন তিনি। কিন্তু পরবর্তী পড়াশোনা কীভাবে করবেন তা নিয়ে শঙ্কায় পড়েন পরিবার। পরে তাঁর এই অদম্য মেধা ও ইচ্ছা শক্তিকে বিবেচনায় নিয়ে ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তির জন্য নির্বাচন করা হয়। এই শিক্ষাবৃত্তি সহায়তার উচ্চমাধ্যমিকেও জিপিএ-৫ পেয়ে সাফল্য ধরে রাখেন তিনি। এই সফলতার জন্য তাঁকে স্নাতক পর্যায়েও শিক্ষাবৃত্তির আওতায় রাখা হয়। পরে তিনি ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ২০১৩-১৪ সেশনে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পড়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন। ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্টের শিক্ষাবৃত্তি সহায়তায় এই বিভাগ থেকে স্নাতক (সম্মান) সম্পন্ন করেন।
সেই ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে চ্যালেঞ্জ নিতে নিতে এখন এটাই ভালো লাগে। তাই আমি চাই পড়াশোনাটা শেষ পর্যন্ত করতে। এখানেই থেমে যেতে চাই না। সামনে টার্গেট হলো, ইউএসএ, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া এই তিনটির একটিতে পিএইচডি করা।
সম্প্রতি তিনি মালয়েশিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফুল ফ্রি ও ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপ নিয়ে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে এমএসসি (মাস্টার্স) শেষ করে দেশে ফিরেছেন। পরিবারের হাল ধরার জন্য শুরু করেছেন চাকরিও। গত মাসে তিনি গাজীপুরের কালিয়াকৈরে অবস্থিত জেনারেল ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডে নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে।
টানাপোড়েনের সংসার থেকে কীভাবে তিনি সফল হলেন, ছোটবেলা থেকে আজকের প্রকৌশলী হওয়ার গল্প, ভবিষ্যৎ স্বপ্নটাই বা কি তাঁর—এ সবকিছু নিয়ে নূরুজ্জামানের জীবনের নানা গল্প উঠে আসে ১২ ডিসেম্বর ২০২২, সোমবার, বেলা ৩টায় প্রথম আলো ট্রাস্টের নিয়মিত আয়োজন ‘অদম্য মেধাবীর সঙ্গে’ অনলাইন অনুষ্ঠানে।
ছোটবেলা থেকে আজকের প্রকৌশলী হওয়ার গল্পটা নূরুজ্জামান জানালেন এভাবে— ‘আমি যখন উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হই তখন অনেক প্রতিযোগিতা করে সুযোগ পেয়েছিলাম। যারা এখানে ভর্তি হয় তারা ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারই হয় বেশি। আমি গণিতে ভালো ছিলাম বলে আমার মনে হয়েছে আমি ইঞ্জিনিয়ার হতে পারব। আলহামদুলিল্লাহ! তাই হয়েছে। তা ছাড়া আমরা যারা অদম্য মেধাবী তাদের সবার গল্প প্রায় একই। অনেক সংগ্রাম করতে হয়। আমাকেও করতে হয়েছে। একটা সময় এমন হয়েছে যে, পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারব কিনা এমন অনিশ্চয়তায় পড়েছি। ষষ্ঠ শ্রেণিতে যখন পড়ি তখন বাসা থেকে ৪ কিলোমিটার দূরের স্কুলে ১ বছর হেঁটে গিয়েছি। একটা সাইকেল কিনার সামর্থ্যও ছিল না। ওই বয়সে হেঁটে যাওয়া…। বাড়িতে বিদ্যুৎ ছিল না, কুপির বাতিতে পড়তাম। কেরোসিন যাতে কম ফুরায় সে জন্য দিনের আলোতে পড়তাম।’
এই যে হাল না ছাড়া… এখন যে ভালো আছেন, ভালো চাকরি করছেন, বাবা-মার অনুভূতি কেমন? উত্তরে তিনি জানানেল. ‘যে পরিবেশ থেকে ওঠে এসেছি এখানে পড়াশোনা চালানোই একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সেখানে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা করেছি। এখান থেকে বিএসসি শেষ করে ফুল ফ্রি ও ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপ নিয়ে মালয়েশিয়া থেকে মাস্টার্স শেষ করে দেশে এসে চাকরিতে ঢুকেছি। সব মিলিয়ে বাবা-মা অনেক খুশি হয়েছেন।’
মানুষের জীবনে উত্থান-পতন থাকবেই, ব্যর্থতা থাকবেই। আমার নিজের কথাই বলি—আমার স্বপ্ন ছিল বুয়েটে পড়ব, কিন্তু সুযোগ হয়নি। তাই বলে হতাশায় হাল ছেড়ে দিইনি।
কি স্বপ্ন দেখেন নূরুজ্জামান? এর উত্তরে তিনি বলেন, ‘সেই ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে চ্যালেঞ্জ নিতে নিতে এখন এটাই ভালো লাগে। তাই আমি চাই পড়াশোনাটা শেষ পর্যন্ত করতে। এখানেই থেমে যেতে চাই না। সামনে টার্গেট হলো, ইউএসএ, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া এই তিনটির একটিতে পিএইচডি করা। ইতিমধ্যে আমার ৩টি গবেষণাপত্র অনলাইনে প্রকাশ হয়েছে। আরও কয়েকটি রেডি আছে। তা ছাড়া মালয়েশিয়া থেকে সনদগুলো এখন তুলতে পারিনি। এগুলো হাতে পেলে, গবেষণাপত্রসহ আগামী বছর থেকে আবেদন করা শুরু করব।’
ছোট অদম্যদের জন্য কি পরামর্শ দেবেন? এ ক্ষেত্রে নূরুজ্জামান বলেন, ‘যারা অধ্যয়নরত আছে তাদের বলব, মানুষের জীবনে উত্থান-পতন থাকবেই, ব্যর্থতা থাকবেই। আমার নিজের কথাই বলি—আমার স্বপ্ন ছিল বুয়েটে পড়ব, কিন্তু সুযোগ হয়নি। তাই বলে হতাশায় হাল ছেড়ে দিইনি। অন্যগুলোতে পরীক্ষা দিয়ে কয়েকটিতে টিকে যাই। পরে চুয়েটে ভর্তি হই। মোদ্দাকথা হলো, যেটা পাইনি সেটার জন্য আফসোস না করে, যেটা পেয়েছি ওটাতে কিভাবে ভালো করা যায় সে চেষ্টা করতে হবে। কখনোই হতাশ হওয়া যাবে না। কনফিডেন্স থাকতে হবে।’
সঙ্গে যুক্ত করে বলেন, ‘প্রথম আলোর কথা না বললে খুব অপরাধ হয়ে যাবে। কারণ প্রথম আলোর জন্য আজ আমি আজকের আমি হতে পেরেছি। প্রথম আলোর সঙ্গে প্রথম পরিচয় যখন অদম্য হিসেবে এসএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পাই। তখন প্রথম আলোর প্রতিনিধি এম. আর. আলম ঝন্টু চাচা বাড়িতে এসে আমাকে নিয়ে নিউজ করেন। পরে বৃত্তিতে অন্তর্ভুক্ত হই। এটা আমাকে অনেক হেল্প করেছে। ২০১১ সাল থেকে পরে অনার্স পর্যন্ত বৃত্তি পেয়েছি। তা ছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমাদের ডাকা, অফিসে ডাকা, সাহস দেওয়া—এগুলোর মাধ্যমে এগোনোর সাহস পেয়েছি। শুধু আর্থিকভাবে নয়, মানসিকভাবেও শক্তি জুগিয়েছে। তাই ব্র্যাক ব্যাংক ও প্রথম আলোর কাছে দাবি, এই বৃত্তিটা যেন বন্ধ না করা হয়। তাহলে আমাদের মতো পরিবারের শিক্ষার্থীরা বিপদে পড়বে!’
প্রথম আলো ট্রাস্টের নিয়মিত আয়োজন ‘অদম্য মেধাবীর সঙ্গে’ অনলাইন এই অনুষ্ঠানটি একযোগে প্রচার করা হয় প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ইউটিউব চ্যানেল এবং প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ফেসবুক পেজ থেকে। সঞ্চালনায় ছিলেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা।