চরের ছেলে হযরত আলীর সফলতার গল্প
শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার প্রত্যন্ত চর কুণ্ডেরচরের অদম্য মেধাবী মো. হযরত আলী। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় প্রবল আগ্রহ তাঁর। কিন্তু বাদসাধে পরিবারের অসচ্ছলতা। এরই মধ্যে পদ্মার ভাঙনে সব বিলীন হয়ে গেলে অন্যের জমিতে ঠাঁই হয় তাদের। পরে একটা সময় ঢাকায় চলে আসে পরিবার। পারিবারিক সমস্যার কারণে প্রাথমিকের পর আবার গ্রামে চলে যেতে হয় তাদের। সাত ভাই এক বোনের মধ্যে হজরত ৬ ষষ্ঠ। বড় তিন ভাই বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছে। বোনের বিয়ে হয়েছে। বাকিরা কিছু পড়াশোনা করে বাদ দিয়েছে। বাবা বর্গাচাষি। মা গৃহিণী।
কিন্তু হযরত দমে যাননি। পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন। নানা টানাপোড়েনের মধ্যেও এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে জিপিএ-৫ পান। কিন্তু পরিবারে আনন্দ নেই। ভর্তি হতে পারবেন কিনা-এমন দুশ্চিন্তায় ছিলেন হযরত। তখন প্রথম আলোর প্রতিনিধি তাঁকে নিয়ে প্রতিবেদন করেন প্রথম আলোয়। প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তাঁকে দেওয়া হয় ‘ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী’ শিক্ষাবৃত্তি।
বৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা করে ২০১৩ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন হযরত। পুনরায় শিক্ষাবৃত্তি অব্যাহত রাখা হয় তাঁর। ভালো করে পড়াশোনা করে ২০১৩-১৪ সেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিবিএ (হিসাববিজ্ঞান) বিভাগে ভর্তি হন। এখান থেকেই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্ব শেষ করেছেন। বর্তমানে তিনি ঢাকায় পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) সহকারী ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত।
প্রথম আলো ট্রাস্টের নিয়মিত অনলাইন আয়োজন 'অদম্য মেধাবীর সঙ্গে’ অনুষ্ঠানের অতিথি ছিলেন অদম্য হয়রত আলী। গত ১৩ জানুয়ারি ২০২৪, শনিবার, বিকেল ৫টায় প্রথম আলো ট্রাস্টের এ অনুষ্ঠানে তাঁর সফল হওয়ার পেছনের গল্প ওঠে আসে।
অনুষ্ঠানে হযরত আলী তাঁর ছোটবেলার গল্প বলতে গিয়ে বলেন, ‘প্রথমেই প্রথম আলোকে ধন্যবাদ জানাই আমাকে আমন্ত্রণ জানানো এবং আমার পথ চলার বিভিন্ন বাধা অতিক্রম করার বিষয়ে বলার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। এখানে একটা কথা বলতে চাই, অনেকই যেখানে শেষ দেখে-আমার মতো যারা, তারা শেষ থেকে শুরু করে। সে জন্য হয়তো সবকিছু অতিক্রম করে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে।’
কেমন ছিল ছোটবেলা? হযরত জানালেন, ‘ছোটবেলা ঢাকায় শুরু হলেও পারিবারিক সমস্যার কারণে জাজিরার প্রত্যন্ত চরে চলে যেতে হয়। সেখানে আমি সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হই। চরে সাধারণত স্কুল দূরে হয়। আমার ছোট যমজ ২ ভাইকেও প্রাইমারিতে ভর্তি করানো হয়। পড়াশোনার তেমন চাপ ছিল না। আমি যখন এসএসসি পরীক্ষা দেব, ওই সময়টাতে ২ ভাইয়ের পড়া বন্ধ হয়ে যায়। তবে আমি নিয়মিত স্কুলে যেতাম। পড়াশোনার প্রতি আমার খুব আগ্রহ ছিল। হারিকেনের আলোয়, টেবিল ছাড়া পড়েছি। খড়ের গাদায় তক্তা পেতে, তাতে কাঁথা বিছিয়ে ঘুমিয়েছি। এভাবে চর থেকে উপজেলায় গিয়ে এসএসসি পরীক্ষা দিই। তখন উপজেলায় বাসা নিয়ে ৪১ দিন থাকতে হয়েছে। তখন দেখতাম সবাইকে তাদের বাবা-মায়েরা দেখতে আসত। আমার বাবা-মা যাননি বা যেতে পারেনি। আসলে তাদের আর্থিক সংকুলান ছিল না। যা হোক, পরীক্ষার পর আমার স্কুলে চরে গণিত ক্লাস নিতাম। আমার স্কুল থেকে ২২ জন পরীক্ষা দিয়েছিল। তার মধ্যে ২০ জন পাস করে, একজন জিপিএ-৫ পায়। সবার পাসের এসএমএস এসেছে কিন্তু আমার আসে না। পরে আমার স্যার খবর পাঠান যে, চরের স্কুল থেকে প্রথম আমি জিপিএ-৫ পেয়েছি এবং উপজেলায় দ্বিতীয় হই। এর পেছনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাই রায়হান ভাইয়ের অনুপ্রেরণা ছিল। তাকে অনুসরণ করতাম। তিনি আমাকে উপজেলার একটা কলেজে ভর্তি করে দেন।’
এর সঙ্গে যুক্ত করে হযরত আরও বলেন, ‘আমার মায়ের অবদান সবচেয়ে বেশি-তিনি হাঁস-মুরগি পালন, ডিম বিক্রি করে বই খাতার ব্যবস্থা করতেন। স্কুলের শিক্ষকগণ অনেক সহযোগিতা করেছেন। আমাকে ফ্রি পড়িয়েছেন, ফ্রি বইপত্র দিতেন। যা হোক, ফল প্রকাশ হওয়ার পর প্রথম আলোর শরিয়তপুর প্রতিনিধি সত্যজিৎ ঘোষ ফোন দেন। কেমনে খোঁজে পেয়েছেন জানি না। আমাকে ফোন দিয়ে বলেন, আমার বৃত্তির ব্যবস্থা হয়েছে-আমাকে ঢাকায় যেতে হবে সংবর্ধনায়। ৫০০ টাকা নিয়ে ঢাকা চলে আসি। বাবাও আমার সঙ্গে ঢাকায় আসেন। অনেক কিছু নতুনভাবে শিখি সংবর্ধনায়। এই বৃত্তি আমাকে এগিয়ে যেতে দারুণ ভাবে সাহায্য করেছে। পরে এইচএসসিতে ভালো ফল করায় আমাকে স্নাতক পর্যায়েও শিক্ষাবৃত্তি দেয় ‘ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী তহবিল’। এই সহযোগিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২১১ তম হয়ে হিসাববিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হই। ট্রাস্টের বৃত্তি এবং ছোট ২ ভাই কাজ করে কিছু টাকা দিত-এভাবে পড়াশোনা চালিয়েছি।’
এদিকে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় বিয়ে করে ফেলেন। এটা নিয়ে পারিবারিক একটা চাপের মধ্যে থাকতে হতো হযরতকে। এরই মধ্যে বউকে পড়াশোনায় সহযোগিতা করেছেন। পরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তির সুযোগ পান।
চাকরি পাওয়ার পর অনুভূতি কেমন? এর উত্তরে হযরত বলেন, ‘আমি আমার স্কুল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম সুযোগ পাই। পরে আরও কয়েকজন চান্স পেয়েছে। সে জন্য একটা বিষয় আমার মধ্যে কাজ করেছে সেটা হলো, আমি যদি কিছু করতে না পারি তাহলে ওরা হতাশ হয়ে যাবে। আমি পরিশ্রম করেছি, সফল হয়েছি। বর্তমানে আমি পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) সহকারী ব্যবস্থাপক হিসাবে আছি। গত ১০ ডিসেম্বর, ২০২৩ এ যোগদান করেছি।’
পরের স্বপ্ন কি? এ প্রসঙ্গে হযরত জানান, ‘৪৩ তম বিসিএসে সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে (হিসাববিজ্ঞান) সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছি। আমার ইচ্ছা বিসিএস প্রশাসনে যাওয়ার। এটা আমার প্রত্যয়। আমি চেষ্টা চালিয়ে যাব স্বপ্নপূরণে।’
অনুষ্ঠানের শেষে হযরত জানান, ‘আমার আজকের এই অবস্থানে আসার পেছনে অনেকের অবদান আছে। আমি চেষ্টা করেছি-প্রথম আলো ট্রাস্ট, ব্র্যাক ব্যাংক সাহায্যে করেছে। সুবিধা নিয়েছি। আমি চাই আমাদের মতো যারা থাকবে তাদের সাধ্যমতো সহযোগিতা করার চেষ্টা করা। আমার চেয়েও অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে অনেকে আছে, তাদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের নৈতিক দায়িত্ব বলে আমি মনে করি।’
প্রথম আলো ট্রাস্টের নিয়মিত আয়োজন ‘অদম্য মেধাবীর সঙ্গে’ অনলাইন এই অনুষ্ঠানটি একযোগে প্রচার করা হয় প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ইউটিউব চ্যানেল এবং প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ফেসবুক পেজ থেকে। সঞ্চালনায় ছিলেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা।