‘অসুস্থ মানুষের পাশে থেকে সেবা দিই— এটা ভালো লাগে’

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স অদম্য মেধাবী উম্মে সালমা।

জয়পুরহাট জেলার আক্কেলপুরের প্রত্যন্ত এলাকার মেয়ে উম্মে সালমা। পাঁচ বোনের মধ্যে চতুর্থ তিনি। বাবা আব্দুল হামিদ অন্যের জমিতে কাজ করে সংসার চালাতেন। মা আনোয়ারা বেগম গৃহিণী। জমাজমি বলতে শুধু বসতভিটা ছিল তাদের। অভাব ছিল নিত্য সঙ্গী। টানাপোড়েনের সংসারে অল্প বয়েসেই চারজনের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। এদিকে ২০০৫ সালে হঠাৎ বাবা মারা যায়। পরিবার তখন দিশেহারা হয়ে যায়। এমতাবস্থায় সংসার কীভাবে চলবে, সালমা পড়াশোনা করতে পারবেন কিনা—সেই অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তে হয় সালমাকে। কিন্তু সব বাধা অতিক্রম করে পড়াশোনা অব্যাহত রেখে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। খবর পেয়ে প্রথম আলোর প্রতিনিধি তাঁকে নিয়ে প্রতিবেদন করেন। ছাপা হয় প্রথম আলোয়। সেই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তাঁকে দেওয়া হয় ‘ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী’ শিক্ষাবৃত্তি।

বৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে বর্তমানে সিনিয়র স্টাফ নার্স হিসাবে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে কর্মরত। আজকের এই অবস্থানে আসার পেছনের গল্প শেয়ার করলেন গত ০৭ এপ্রিল ২০২৪, রোববার, বেলা ৩টায় প্রথম আলো ট্রাস্টের আয়োজনে 'অদম্য মেধাবীর সঙ্গে’ অনলাইন অনুষ্ঠানে।

সালমা ২০১০-১১ সেশনে বগুড়া নার্সিং কলেজ ভর্তি হয়ে ২০১৪ সালে ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন। ডিপ্লোমা সম্পন্ন করার পর স্থানীয় একটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট অ্যান্ড মেডিকেল টেকনোলজি নামক প্রতিষ্ঠানের নার্সিং বিভাগে ইনস্ট্রাক্টর হিসেবে চাকরি শুরু করেন। ২০১৬ সালের সিনিয়র স্টাফ নার্স নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা মেডিকেলে যোগদান করেন। বর্তমানে সিনিয়র স্টাফ নার্স হিসাবে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে কর্মরত।

চাকরিতে প্রবেশের পর রাজশাহী মেডিকেল কলেজ থেকে ২০২৩ সালে বিএসসি ইন নার্সিং সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এমপিএইচ পড়াশোনা করছেন তিনি।

সালমা তাঁর ছোটবেলা, তাঁর স্বপ্ন ও নার্স পেশার যুক্ত হওয়ার বিষয়ে কথা হলো। তিনি জানালেন, ‘আমার ছোটবেলা বলতে. . , দরিদ্র পরিবার আমাদের। অষ্টম শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় বাবা মারা যান। সেই থেকে প্রতিকূলতা আরও বেড়ে যায়। অষ্টম থেকে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাই। পরে শিক্ষক ও প্রথম আলোর সহায়তায় এগিয়েছি। ছোট থেকেই পড়াশোনায় ভালো ছিলাম। শিক্ষকেরা অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। সবার সহায়তায় মনোবল শক্ত করে এগিয়েছি।’

সালমা তাঁর স্বপ্নের বিষয়ে বলেন, ‘এখনো পড়াশোনা করছি। প্রথমে মনে হয়েছে ভালো ছাত্রী হওয়ার সত্ত্বেও নার্সে পড়াশোনা করতে যাব? প্রথমে এটা ভালো লাগত না। কিন্তু মনে পরে হয়েছে এটা একটা সেবামূলক এবং মহৎ পেশা। এখন অনেক ভালো লাগে, ভালো আছি। এখন আমার স্বপ্ন হলো—এই প্রফেশনের সর্বোচ্চ জায়গায় যাব।’

মায়ের অনুভূতি কি! জানাতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মা অনেক খুশি। অন্য অনেক মেয়েদের তুলনায় ভালো আছি। আমার জন্য মা অনেক কষ্ট করেছেন। সেই কষ্ট সফল করতে পেরেছি। প্রতিকূলতা পেরিয়ে মহৎ পেশায় আছি।’

রোগীদের নিয়ে অভিজ্ঞতার বিষয়ে বলেন, ‘রোগীরা নার্সদের কাছের মানুষ মনে করে। আমিও তাই মনে করি। মানবিকতার সঙ্গে আচরণ করি। অসুস্থ মানুষের পাশে থেকে সেবা দিই— এটা ভালো লাগে। কোভিডের সময়ও সার্বক্ষণিক সেবা দিয়ে গেছি। অসুস্থও হয়েছি।’

যারা পড়াশোনা করছে তাদের মানসিকভাবে শক্তিশালী হতে হবে। ধৈর্যশীল হতে হবে। মানিয়ে নিতে হবে। যা আছে তার মধ্যে ভালোটা খুঁজে নিতে হতে, হতাশ হওয়া যাবে না।

এখনো পড়ালেখা করছেন—নিজেকে কোথা দেখেতে চান? সালামর সাবলীল উত্তর, ‘ডাক্তার হতে পারিনি। সেই পরামর্শ পাইনি। তবে বিএসসি করেছি, এখন এমপিএইচ করছি। নার্সিং পেশায় সর্বোচ্চ জায়গায় যেতে চাই আমি। আমার ৭ বছরের এক মেয়ে আছে। সে বলে—তুমি এত পড়ালেখা কর কেন? তোমার ড্রয়িং করতে হয়...? আমি বলি, না মা—আমি যেটা করি সেটা ভালো ভাবে করতে চেষ্টা করি। যেহেতু পড়ছি, একটু ভালো করে করলে কেমন হয়!

এখন যারা অদম্য আছে তাদের জন্য সালমার পরামর্শ হলো, ‘যেকোনো পরিস্থিতিই মোকাবিলা করা সম্ভব। যদি মনোবল থাকে, ইচ্ছাশক্তি থাকে। কোনো পরিবেশে সেটা ম্যাটার করে না। যারা পড়াশোনা করছে তাদের মানসিকভাবে শক্তিশালী হতে হবে। ধৈর্যশীল হতে হবে। মানিয়ে নিতে হবে। যা আছে তার মধ্যে ভালোটা খুঁজে নিতে হতে, হতাশ হওয়া যাবে না।’

প্রথম আলো ট্রাস্টের নিয়মিত আয়োজন ‘অদম্য মেধাবীর সঙ্গে’ অনলাইন এই অনুষ্ঠানটি একযোগে প্রচার করা হয় প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ইউটিউব চ্যানেল এবং প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ফেসবুক পেজ থেকে। সঞ্চালনায় ছিলেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা।