ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেলে, তারাই তখন বাবা-মা হয়ে যায়

অদম্য মেধাবী শহিদুল্লাহ হাবীব।

‘ছোটবেলার ঈদে বাবা তাঁর সাধ্যমত আমাদের কিছু না কিছু কিনে দিতেন। এখন বড় হয়েছি,  আমি বাড়ির সবার জন্য ঈদে কেনাকাটা করি। ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেলে, তারাই তখন বাবা-মা হয়ে যায়। আর আমার তো এখন তিন ছেলে- মেয়ে। আমার মেয়ে হুমাইরা, আমার মা-, আমার বাবা। সবার দায়িত্ব আমার। এই দায়িত্ব যে কি সুখের বলে বোঝাতে পারবোনা’-এমনটাই বলছিলেন অদম্য মেধাবী শহিদুল্লাহ হাবীব।  বর্তমানে শহিদুল্লাহ হাবীব ওয়াল্টন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজে সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট অফিসার-১ হিসেবে কর্মরত আছেন। অথচ তাঁর ছোটবেলা কেটেছে অন্যরকমভাবে। পাঁচ ভাইবোনের সংসার চালাতে যখন শহিদুল্লাহর বাবা হিমশিম খাচ্ছিলেন, তখন একদিন হঠাৎ বাদামের ঝুরি হাতে তুলে দিয়ে তাঁর বাবা তাঁকে বললেন বাদাম বিক্রি করতে। শহিদুল্লাহ তখন সবে তৃতীয় শ্রেনির ছাত্র। টানাটানির সংসারে বাদাম-বিস্কুট বিক্রি করলেও মন পরে থাকতো সেই ক্লাসরুমে।  স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা যেন বুঝতে পারছিলেন সেই ছোটছেলেটার মনের কথা। আবারও তৃতীয় শ্রেনিতে ভর্তি করে নিলেন শহিদুল্লাহকে। কিন্তু থেমে থাকলোনা বাদাম বিক্রির কাজ। এইরকম করেই পঞ্চম শ্রেনিতে পুরো উপজেলায় মেধা তালিকায় ১০ম হয়ে বৃত্তি পেলেন।

অদম্য মেধাবী শহিদুল্লাহ হাবীব।

এতো ভালো ফলাফলের পরেও বাবা বললেন, মনোযোগ দিয়ে কাজ করো। ষষ্ঠ শ্রেনিতে ভর্তির টাকা ছিলোনা, হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার সহায়তায় ষষ্ঠ শ্রেনিতে ভর্তি হলেন। ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত বৃত্তির টাকায় পড়াশোনা চালিয়ে নিতে পারলেও এরপর যেন আর সম্ভব হচ্ছিলনা। শুরু করলেন বাবার সঙ্গে চাতালে (ধান ভাঙ্গা, চাল তৈরি) কাজ করা। সারাদিন ক্লাস করতেন, বন্ধুদের সঙ্গে খেলতেন, রাতে চাতালে কাজ করতেন। নিজেদের থাকার জায়গাটা পর্যন্ত ছিলোনা। চাতালের পাশেই পরিবারসহ থাকতেন সবাই। চাতালের বারান্দায় ঘুমাতেন, রাস্তার লাটের আলোতে পড়াশোনা করতেন। জীবনের যত কঠিন রুপ ছিল, যেন কিছু দেখা বাকি ছিলোনা শহিদুল্লাহর। সেইযে ছোটবেলা থেকে এতো যে বৈরিতার সঙ্গে যুদ্ধ। তা বৃথা যায়নি। ২০১৪ সালে জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি পাশ করে শহিদুল্লাহ। পেয়ে যান ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তি। ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ইচ্ছে ছিল শহিদুল্লাহর। কিন্তু ছোটবেলা থেকে এতো অভাব দেখেছেন। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর তাগিদটাই বেশি ছিল। পলিটেকনিকে ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি হলেন। একদিকে শিক্ষাবৃত্তির টাকা দিয়ে পড়াশোনা করেন আর টিউশনির টাকা বাড়িতে পাঠাতেন। পড়াশোনার পাট চুকিয়ে ২০১৮ সালে প্রাণ আরএফএলে চাকরি জীবন শুরু করেন। বর্তমানে ওয়াল্টন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজে সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট অফিসার-১ হিসেবে কাজ করছেন। সেদিনের সেই ছোট শহিদুল্লাহ আজ বাবা-মা, ভাইবোনদের দায়িত্ব নিয়েছেন। বিয়ে করেছেন, কন্যা সন্তানের বাবা হয়েছেন। ভালো থাকার স্বপ্ন দেখে যাচ্ছেন এখনও। সরকারি চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

‘অদম্য মেধাবী’ শিক্ষাবৃত্তি সারা দেশের গরিব, কিন্তু মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের জন্য খুলে দিয়েছে সম্ভাবনার দুয়ার। অদম্য মেধাবীদের একেকটি গল্প অন্যদের জন্য হয়ে উঠেছে অনন্ত অনুপ্রেরণার উৎস। প্রথম আলো ২০০৭ সাল থেকেই এই শিক্ষাবৃত্তি দিয়ে আসছে। তবে ট্রাস্ট গঠনের পর থেকে এটি নিয়মিতকরণ করা হয়। ২০১০ সালে ব্র্যাক ব্যাংকের যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে এর পরিধি বাড়ে। ব্র্যাক ব্যাংক ও অন্য দাতাদের সহযোগিতায় এখন পর্যন্ত মোট অদম্য মেধাবীর সংখ্যা ১ হাজার ১৩৪ জন শিক্ষার্থী সহায়তা পেয়েছেন। এর মধ্যে ব্র্যাক ব্যাংকের সহায়তায় মোট ৩১৯ জন শিক্ষাবৃত্তি পেয়ে স্নাতক সম্পন্ন করছেন। ব্র্যাক ব্যাংক- প্রথম আলো ট্রাস্ট  অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে শহিদুল্লাহ সহ ১৬জন ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেছেন।