রেজিস্টার্ড নার্স লাইসেন্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন অদম্য শারমিন

নওগাঁর মান্দা উপজেলার সাহাপুকুরিয়া গ্রামের দরিদ্র পরিবারের মোছা. শারমিন পারভিন। অনেক প্রতিকূলতা অতিক্রম করে আজ সফল হওয়ার পথে শারমিন। তিনি ‘ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধবী তহবিল থেকে শিক্ষাবৃত্তি পেয়ে পড়াশোনা করেছেন। সম্প্রতি রেজিস্টার্ড নার্স লাইসেন্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। এখন কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের পালা। বাবা-মার ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পর নানাবাড়িতে থেকে পড়াশোনা করেছেন। আজ শেয়ার করছেন নিজের এগিয়ে যাওয়ার গল্প। লিখেছেন তিনি নিজেই।

আমি মোছা. শারমিন পারভীন, ২০১৭ সালের প্রথম আলোর অদম্য মেধাবী। ২০২৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর সদ্য হওয়া লাইসেন্স পরীক্ষায় রেজিস্টার্ড নার্স হিসাবে উত্তীর্ণ হয়েছি। এই নার্স হওয়ার জার্নিটা খুব সহজ ছিল না। সেই জার্নিটা আমি সবার সঙ্গে আজ শেয়ার করতে চাই। আমার বয়স যখন ৩ মাস তখন আমার মা-বাবার ডিভোর্স হয়ে যায়। তারপর থেকে আমার মা, নানা-নানি অনেক কষ্ট করে আমাকে মানুষ করেন। আমার সব পড়াশোনার খরচ তারা কাজ করে, পরিশ্রম করে জোগাড় করছে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, আমি যখন ক্লাস টেনে (২০১৬ সালের জানুয়ারি) একদিনের ব্যবধানে নানা-নানি মারা যান। তখন পরিবারে শুধু মা আর আমি। আমার মায়ের সংগ্রাম তখন দ্বিগুণ হয়ে যায়।

স্কুলে পড়াশোনা অবস্থায় আমার হাই স্কুলের শিক্ষক রা আমাকে খাতা থেকে শুরু করে বিনা বেতনে প্রাইভেট পড়ানোসহ অনেক সাহায্য করছেন। তাদের  ঋণ কোনোদিন শোধ করতে পারব না। তারপরও আল্লাহর রহমতে সেই স্কুল থেকে আমি এসএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়ে পাস করি। সবাই অনেক খুশি ছিল কিন্তু আমি আর আমার মা খুশি ছিলাম না। কারণ আমার স্বপ্ন ছিল ডক্টর হব। কিন্তু পড়াশোনার এত খরচ কীভাবে বহন করব, কিভাবে সামনে এগোব এসব ভেবে অনেক কান্না করতাম। পরেআমার এক মামার মাধ্যমে প্রথম আলোর সাংবাদিকের কাছে যাই। উনি আমাকে নিয়ে নিউজ করেন এবং ব্র্যাক ব্যাংক- প্রথম আলো ট্রাস্ট্রের অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তির জন্য নির্বাচন করেন।

এই বৃত্তির সহায়তায় আমি আমার কলেজে পড়াশোনা ও পরিবারের খরচ চলত। আল্লাহর রহমতে এইচএসসি পাস করে নিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সব সামলিয়ে অনেক চিন্তার মধ্যে এইচএসসি ফলাফল একটু খারাপ হয়। তখন অনেক ভেঙে পরি। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিলেও হয়নি। পরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন অনার্সে ভর্তি হই। কিন্তু মন মানত না। অনেক ভেবেচিন্তে নার্সিং পরীক্ষায় অংশ নিই। সরকারি নাসিংয়ে সুযোগ হলো না। আমার দ্বারা কিছু হবে না ভেবে অবার ভেঙ্গে পরি। এ সময় রাজশাহীতে বেসরকারি একটি নাসিং কলেজের এমডি স্যার আমার রেজাল্ট দেখে আমাকে সাহস দেন। উনি ব্যবস্থা করবেন বলে সাহস দিলে বাড়ির গরু ছাগল বিক্রি করে মাকে নিয়ে শহরে চলে আসি।

শুরু হয় আমার নতুন জীবনসংগ্রাম। আমার মা বাসা বাড়িতে কাজ করত। সেই টাকা দিয়ে রুম ভাড়া, খাওয়া কলেজ বেতন চালাতে হতো। কোনো সমস্যা হলে আমার কলেজের স্যারকে বললে সমস্যাগুলো সমাধান করতেন এবং আমার আরেকজন শিক্ষক রাগিব স্যার, উনি আমাকে অনেক সাহায্য করছেন। আমার এমন সময় গেছে যে, না খেয়ে থাকতে হয়েছে। তখন অনেক ভেঙে পরতাম। কলেজের ফরম পূরণ আর সেশন ফি, এসব নিয়ে অনেক ভেঙে পরতাম। পরে শেষ সময়ে প্রথম আলো আমাকে আবারও সাহায্য করে পথ এগিয়ে দেয়। যার কারণে সময় ঋণী তাদের কাছে।

আমার পথ চলায় আমার পরিবারের কিছু মানুষ, আমার কিছু রিলেটিভ যাদের সঙ্গে আমার কোনো রক্তের সম্পর্ক নাই কিন্তু আমাকে অনেক অনেক সাহায্য করেছেন। এই সহায়তা  না পেলে হয়ত এত দূর আসতে পারতাম না। আমার মা ৩-৪ বাড়িতে কাজ করত। অনেক কষ্ট হতো মার, অসুস্থ হয়ে যায় কান্না করত, কিন্তু কিছুই করতে পারতাম না। শুধু আল্লাহর কাছে বলতাম, আল্লাহ আমাকে এক চান্সে লাইসেন্স পাস করে দাও। চাকরি করে মায়ের কষ্ট দুর করব। কয়েকদিন আগে রাত ১২টায় যখন নার্সিং লাইসেন্স পরীক্ষার ফল প্রকাশ করে, ফল পেয়েই মাকে প্রথম ফোন করে পাস করার খবর বলেছি। এ সময় মায়ের খুশি আমি বলে বোঝাতে পারব না।

মায়ের পাশাপাশি আমার বড় মামি, ছোট মামি, মামারা আমার পাশে ছিল, সবাইকে খুশি করতে পেরেছি। এখন যদি ভালো একটা ক্লিনিক বা হাসপতালে চাকরিতে প্রবেশ করতে পারি তাহলে অন্তত মায়ের কষ্ট দুর করতে পারব। মাকে সুখ দিতে পারবে। আর পাশাপাশি নার্সিংয়ে সরকারি চাকরির জন্য চেষ্টা করে যাব।

আমি ভাবতেই পারিনি যে, এত কষ্টের পর আমি এই জার্নিটা শেষ করতে পারব। কিন্তু সবার ভালোবাসা, সবার পাশে থাকা, ভালোবাসার মানুষদের অনুপ্রেরণা আর আমার চেষ্টায় আজ শেষ করতে পেরেছি। সবকিছুর জন্য আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ, আলহামদুলিল্লাহ্‌। সবশেষে  প্রথম আলোকে অনেক অনেক ধন্যবাদ আমাকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য। আমি চেই আমার সামনের পথচলাতে পাশে থাকার জন্য, একটা কর্মসংস্থান এর ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য। সবাইকে ধন্যবাদ।